সাইটটি নির্মাণাধীন রয়েছে, ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মহর্ষি শ্রীশ্রী তারক চন্দ্র সরকার
আবির্ভাব ১২৫২ বঙ্গাব্দে, ১৫ই অগ্রহায়ন, শনিবার,
অমাবস্যা, অনুরাধা নক্ষত্র। ১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ২৯ নভেম্বর।
বর্তমান নড়াইল জেলার লোহাগড়া থানাধীন নবগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত জয়পুর গ্রামে জন্ম হয়। পিতা কাশীনাথ সরকার, মাতা অন্নদা বা অন্নপূর্ণা দেবী। পিতৃপুরুষদের পূর্ব পদবী ছিল কাঁড়ার। তাঁর পূর্ব পুরুষগণের নাম, রণকৃষ্ণ ও জয়কৃষ্ণ দুই ভাই। জয়কৃষ্ণের ৭ জেলে: ১. শিবনাথ; ২. ভবনাথ; ৩. শম্ভুনাথ (অন্ধ); ৪. শিরোমণি; ৫. হরনাথ; ৬. চূড়ামণি; কাশিনাথ (তারক চাঁদের পিতা। চূড়ামণি ও শিরোমনি দারোগা।
শ্রীশ্রী তারকচাঁদের বাল্যশিক্ষা (শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ২৮৭)..
পাঁচ বছর বয়সে পিতার কোলে বসে কাব্যগাথা রচনা করেন। পরে পাঠশালায় গমন, বর্ণশিক্ষা একদিনে শেষ। সংযুক্ত বর্ণের খেলা শিক্ষা করে একবেলা, আদি পাঠ তিন দিনে শেষ। প্রথম মানের যত বিদ্যা তিন দিনে শেষ করে, দ্বিতীয় মানের পড়া সপ্ত দিনে হ'ল সারা, এই ভাবে ছয় মাসে শিখলেন ছাত্রবৃত্তি পাঠ যা ছিল। কাশীনাথ বলে তাই আর পড়ে কার্য নাই, কবি গান শেখা এবে ভাল। ১৫ বছর বয়সে পিতৃবিয়োগ।
স্বামী মহানন্দ পাগল
স্বামী মহানন্দ পাগলের জীবন কথা:
গোপালগঞ্জ জেলার সদর উপজেলাধীন নারকেলবাড়ি একটি ছোট্ট গ্রাম। এই গ্রামে মন্ডল বংশ একটি বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী বংশ। এই বংশে যত লোক জন্মেছেন তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন মহৎ ও হরিভক্ত। এই বংশেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন হরিচাদের প্রিয় ভক্ত গোলোক পাগল। তাঁরই ভ্রাতুষ্পুত্র ছিলেন মহানন্দ পাগল-যাঁকে ভক্তরা ছোট পগল বলেই চেনেন। মহানন্দ পাগলের পিতার নাম সহস্রলোচন। মাতা সুচিত্রা মন্ডল। স্বামী মহানন্দের আর একটি ভাই ছিলেন। তাঁর নাম দশরথ। তিনিও হরিভক্ত। মহানন্দের জন্য তারিখ ১২৫৯ বঙ্গাব্দের ২রা ফাল্গুন (১৮৫৩ এর ১২ ফেব্রুয়ারী)।
বয়ঃক্রমে মহানন্দ কৃষিকাজে যোগ দেন। কিছুদিন পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর স্ত্রীর নাম দুর্গারাণী। মূলতঃ তিনি স্বামী গোলোক পাগলের মাধ্যমে মতুয়া ধর্মে অনুপ্রাণিত হন। কথিত আছে, গোলকের দেহবসানের পর তাঁর অঙ্গ থেকে দু'টি জ্যোতি উঠে আকাশ মার্গে যায়। এক জ্যোতি তারকের দেহে মেশে অন্যটি নারকেলবাড়ি গিয়ে মহানন্দের দেহে প্রবিষ্ঠ হয়। এভাবেই তিনি শক্তিমত্ত হন। গোস্বামী গোলোক তারকের বাড়ি জয়পুরে দেহ ত্যাগ করেন। এখবর পেয়ে গোস্বামী মহানন্দ উন্মাদের মত হন। গোলোক যে আর নেই এটা তিনি কোনমতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। উন্মত্ত অবস্থায় তিনি ঘূর্ণাবর্তের মত ছোটা ছুটি করতে থাকেন। যে যে বাড়িতে গোলক যেতেন তিনিও সেই বাড়িতে তাঁকে খুঁজতে থাকেন। কোথাও খুঁজে না পেয়ে অবশেষে তিনি ফুকুরা যান এবং মধুমতি নদীর কূলে গিয়ে বসে পড়েন। গোলকের বিরহে তখন তাঁর দেহ দগ্ধীভূত হচ্ছে। জ্বালা জুড়াতে তিনি জলে ঝাঁপ দেন। তাপ পেয়ে জল সবেগেল। নদীমধ্যে যত দূর অগ্রসর হতে লাগলেন ততই জল সরে যেতে থাকে। তাঁর দেহ থেকে জল দুই হাত পরিমান সরে যায়। হাত দিয়ে জল ছিটাতে থাকেন। এসময় ঘটল এক বিস্ময়কার ঘটনা। জলস্তম্ভের মধ্য থেকে গোস্বামী গোলোক মূর্তিমন্ত হয়ে দাঁড়ালেন এবং বললেন বাপরে মহানন্দ, কেন এত দুঃখ করছো? আমি তোমাকে ছেড়ে যাইনি। জ্যোতি হয়ে তোমার দেহে ঠাঁই নিয়েছি।
এই আমি তোর দেহে করিনু প্রবেশ।
তুই রাজা হরিচাঁদ ভক্ত রাজ্য দেশ।।
চিরদিন তরে মম এই মনোসাধ।
কুটি নাটি কাটি দেশ করিবি আবাদ।। শ্রী শ্রী হরি লীলামৃত ২৩৪/১
এর পরে গোস্বামী মহানন্দ সেখান থেকে বাড়ি চলে আসেন।
দীননাথ নামে নারকেলবাড়ি আর এক ভক্ত ছিলেন। তাঁর সংগে মহানন্দের খুব আন্তরিকতা ছিল। গোস্বামী যেখানে যেতেন দীননাথ তাঁর সাথে যেতেন। যখন হরিনামে মত্ত হয়ে সবাই প্রেমানন্দে ভাসতেন। সবাই দেখতেন পাগল সেখানে নেই। তখন হায় হায় করে সবাই কাঁদতেন।
খাসিয়ালী গ্রামে নবীন চন্দ্র বসু নামে ঠাকুরের এক ভক্ত ছিলেন। তাঁর সংসারে স্ত্রী ও এক কন্যা বিদ্যমান। সবাই ঠাকুরের ভক্ত। আবার গোস্বামী মহানন্দকে তাঁরা দারুণ ভক্তি করতেন। একদিন
গোস্বামী বাড়িতে আছেন। দীননাথকে জেকে তাঁর সাথে খাসীয়ালী যেতে বলেন। হঠাৎ খাসীয়ালী যাতা কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেন- ঐ গ্রামে নবীন বসুর স্ত্রী আমার জন্য পিঠা বানিয়ে রেখেছে। আমি খাওয়া পর্যন্ত তারা কিছুই মুখে দেবেনা। চল এক্ষুণি সেখানে যেতে হবে। এ দিকে হয়েছে কী- মান বেলা নবীনের কন্যা তার মাকে বলেছে-মা, পিঠা তৈরী কর। পাগল আজ আমাদের বাড়ি আসবে। ঘাঁতে পিঠা খাওয়াতে হবে। তার মা প্রথমে মেয়ের কথা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। পরে বিশ্বাস করে দি তৈরী করলেন। নবীন বসু এখবরটি শুনে বললেন- তোমরা কী ভাবে জানলে যে পাগল আমাদের বা আসবে? যদি না আসে তবে যেভাবেই হোক এনে দেয়া চাই। নইলে কিন্তু ভাল হবে না। এই হটা রাগের সাথে অন্য ঘরে চলে গেলেন। স্ত্রীও মেয়েকে কড় স্বরে বললেও অন্তরে ছিল প্রগাঢ় ভক্তি। এমিরে রাত বেড়ে যাচ্ছে অথচ মহানন্দ পাগল আসছে না। নবীন বসু একবার বসে কাঁদছেন আর তাঁর হও কন্যা অন্য ঘরে বসে কাঁদছেন। সবাই অদ্ভুক্ত।
এদিকে গোস্বামী মহানন্দ ও দীননাথ পথে চলতে চলতে বিভিন্ন বাড়িতে ভ্রমণ করতে করতে আনেক রাতে মধুমতি নদীর ঘাটে এসে দেখেন মাঝি নৌকা নিয়ে তাঁদের অপেক্ষায় আছে। যাত
এলেই মাঝি বলে- তোমাদের জন্যই বসে আছি, তাড়াতাড়ি এসো পার করে দেই। মাঝি তাঁদের পর করে দিলে তাঁরা হাঁটতে থাকেন। পথে দীননাথ ভাবতে লাগলেন- এত রাতে কে পার করে দিল? সন্দেহ দ্যোব্দুল মনে পুনরায় ঘাটে এসে দেখেন নৌকা মাঝি কেউ নেই। এত অল্প সময়ের মধ্যে কোথায় গেল। গোস্বামীর কাছে জিজ্ঞাসা করলেন- এত রাতে আমাদের কে পার করে দিল আর মাঝি ও নৌকা কিছুই দেখলাম না। যে কোথায় গেল? আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না? গোস্বামী মৃদু হেসে বললেন- ওসরে তোমার দরকার নেই। যার কাজ সেই করে গেছে। পাটনী ছাড়া কে আর পার করতে আসবে?
কথা বলতে বলতে তাঁরা দু'জন এক সময় নবীনের বাড়ি এসে উপস্থিত হলেন। নবীনের স্ত্রী দু'জনকে দেখে তাড়াতাড়ি পা ধোয়ার জল দিলেন। বসতে বিছানা করে দিলেন। স্বামী ও মেয়েবে বললেন- তোমরা তাড়াতাড়ি এস। পাগল গোস্বামী এসেছে। তাঁরা এলে সবাই মিলে তাঁর পায়ের উপর গিয়ে পড়লেন। নয়নের জলে বুক ভেসে গেল। তাঁদের ভাব দেখে দীননাথও স্থির থাকতে পালেন না। পরে গোস্বামী সবাইকে শান্ত করলেন। নবীনের পিঠা বানানোর ইতিবৃত্ত দীননাথ জানতেন না। নবীন এর কাছে সেটা জেনে তিনি আধি জলে ভাসলেন।
মনে ভাবে এয়া হয় কোন দেশী ভক্ত।
ইহাদের ভক্তি রজ্জু অতিশয় শক্ত।।
প্রেমের সন্ধান আমি বুঝিনু এখন।
সত্য সত্য এয়া হয় প্রেম মহাজন।। শ্রীশ্রী হরি গুরুচাঁদ চরিত্র সুখা ২২০/২
কিছুক্ষণ পর সবাই সুস্থ হলেন। নবীন বসুর স্ত্রী মহানন্দে সবাইকে পিঠা খাওয়ালেন। পরদিন, ভোরে দীননাথকে নিয়ে গোস্বামী মহানন্দ ঘরে ফিরে এলেন।
গোস্বামীর শালনগর গমন:
গোস্বামী মহানন্দ অহর্নিশি হরিনামে মেতে থাকতেন। মাঝে মাঝে বিভিন্ন ভক্তের ডাকে তাদের বাড়িতে যেতেন। সেখানে গিয়েও হরিনামে সবাইকে মাতিয়ে তুলতেন। তাঁর সংগে বহু ভক্ত থাকফোর একবার ভক্তদের নিয়ে তিনি কুন্দসী গ্রামে এলেন। তাঁর সংগে বহু ভক্তের আগমনে অদ্বৈত, দীননাথ ও কালাচাঁদ এই কয়জনের বাড়ি পরিপূর্ণ হয়ে গেল। সেখান থেকে কিছু ভক্ত জয়পুরে তারকের বাড়ি চলে গেলেন। এরপর সবাই এলেন শালনগর গ্রামে। শালনগরে বহু পাল সম্প্রদায়ের বসতি বাতামের অনেকেই ঠাকুরের ভক্ত। পালপাড়ায় এসে গোস্বামী সহ অন্য ভক্তরাও নামে মেতে বাহ্যজ্ঞান হারা হন। দিঘলিয়া গ্রাম নিবাসী মধুসুদন চক্রবর্তী জাতিতে ব্রাহ্মণ। তাঁর ছেলে অক্ষয় চক্রবর্তী। এই অক্ষয় চক্রবর্তী পৈতা ছিড়ে ব্রাহ্মণত্ব ত্যাগ করে মতুয়া হন। তাঁর শুরু হলেন কবিরসরাজ তারক চন্দ্র। তিনিও পালপাড়ায় এসে কীর্তনে মেতে ওঠেন। কীর্তনের মাঝে তিনি মনের আনন্দে গোস্বামী মহানন্দকে কাঁখে তুলে নাচতে লাগলেন। এই ভাব দেখে সবাই দ্বিগুণ উৎসাহে হরিনাম করতে লাগলেন। ক্ষণিক পরে সবাই মিলে অক্ষয় চক্রবর্তীকে কাঁধে করে নাচতে থাকেন। সবাই যেন বাহ্য জ্ঞান হারা। নামের হিল্লোলে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, পাল, সাহা, নমঃশূদ্র সবাই একাকার হয়ে গেল। মহাভাবে রাত শেষে প্রভাত হল।
এই কীর্তনের মাঝে গোস্বামীর অদ্বৈত আবেশ হয়। সেই আবেশে তিনি কথা বলতে থাকেন। তিনি বলেন- তোরা সবাই এলি, আমার সে কই? যাঁকে এনে আমি 'নাড়া' নাম ধরি, যাঁকে আনার জন্য আমি এত সাধ্য-সাধনা করলাম, যাঁর জন্য ফুল তুলসী উজানে ধেয়ে গেল, আমার সেই পরাণের পরাণ শ্রীগৌরাঙ্গ কই? শুনে অক্ষয় চক্রবর্তী বলেন- শোন ওরে নাড়া, যাঁকে তুই খুঁজছিস সেই গোরাচাঁদ এবার ওড়াকান্দী হরিচাঁদ রূপে এসেছে। এখন তিনি তাঁর পুত্র গুরুচাঁদে মিশে গেছেন।
তাঁর হরিচাঁদ গুরুচাঁদে মিশিয়োছে।
মানুষে মানুষ মেশা বর্তমান আছে।। শ্রীশ্রী হ.গু.চ.সু পৃঃ ২৩৫/২
দু'জনে যেন মোহপ্রাপ্ত, জ্ঞান নেই। অন্য মতুয়ারা হরি বলছে। রাত শেষে তাঁদের দশা ভঙ্গ হল। নাম সংকীর্তন থেমে গেল। সকাল বেলা আহারাদি সম্পন্ন করে সবাই আবার নামে মেতে উঠলেন। নেচে গেয়ে মধুমতির জলে স্নান ও জলকেলী করলেন। এর পর তাঁরা সবাই তাঁরাচাদের বাড়ি আসলেন। সেখানে দধি, দুগ্ধ, চিড়া, চিনি ও ফলাহার করে পূর্ণ মহোৎসব করলেন।
শাহাবাজপুর রাখালদের সংগে খেলা:
একবার সাহাবাজপুর গ্রামে তপস্বীপালেন বাড়ি মহানন্দ গোস্বামীর মহোৎসবের নিমন্ত্রণ হল। মতুয়াদের নিয়ে তিনি দুপর বেলা রওনা হলেন। হরিবলে প্রেমানন্দে তাঁরা চলতে লাগলেন। দলে সাত ভাগ হয়ে তাঁরা চলতে লাগলেন। পাল বংশে প্রথম মতুয়া হন হরিপাল। এর পর একে একে গোলোক পাল ও তাঁর চার পুত্র-হরিশচন্দ্র, দুর্গাচরণ, প্রহ্লাদ ও গৌর মতুয়া হয়ে হরিনামে মাতোয়ারা হন। এসব পালেরাও গোস্বামীর সংগে আছেন। এই দলে আরো আছেন- পূর্ণচন্দ্র অধিকারী, কবিরসরাজ তরক চন্দ্র। এক এক দলে পঞ্চাশ জনের মত মতুয়া। সবাই মিলে মনের আনন্দে হরি বলছে। জটকের বিলের মধ্যে বেশ কয়েকজন রাখাল বালক গরু চরাচ্ছে আর খেলা করছে। হরিবোল শুনে তারাও মতুয়াদের সংগে মিশে গেল। এই দলে ছিলেন তারকচন্দ্র। ব্রজভাবে তাঁর মন উদ্দীপ্ত হল। ভাবাবেশে তিনি রাখালদের উদ্দেশ্যে বলেন। তোরাতো ব্রজে ছিলি ব্রজের বালক। তোরা একবার ব্রজভাবে বল হারে বে বে। আজ তোরা আমাদের সংগে নাচ। তাই শুনে রাখালরা নৃত্য করতে লাগল। তাদের চরিদিকে ঘিরে মতুয়ারা হরিনাম করতে লাগলেন। সবাই নাচে-গায় আর মাঝে মাঝে হরি ধ্বনি দেয়। রাখালরাও প্রেমে মত্ত। জলে, স্থলে, শূণ্যে যেন হরি বোল ধ্বনি। এসময় তারক চন্দ্র অক্ষয় চক্রবর্তীকে টেনে নিলেন। পূর্ব চন্দ্র ও হরি পাল বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে 'আবা' ধ্বনি দিতে লাগলেন। তাই শুনে গরুর পাল দড়ি ছিড়ে ছুটে এসে হাম্বা হাম্বা রব তুলে লেজ উঁচু করে, উর্দ্ধ কর্ণে নাচতে লাগল। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। এ দৃশ্য না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। এ দৃশ্য দেখে সবাই কেঁদে আকুল হলেন। মানুষ গরু একত্রে নাচছে।
পিছে ছিলেন গোস্বামী মহানন্দের দল। দ্রুতবেগে তাঁরা হাজির হয়ে কীর্তনে যোগ দিলেন। গোস্বামী লাফ দিয়ে জটকের খাল পার হলেন। তাই দেখে অন্যেরাও জলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ঝাঁপাঝাঁপি করে কেউ ওপার গিয়ে উঠলেন। অনুমান দুই রশি চওড়া খাল। মহানন্দ গোস্বামী এক লাফে সেটা পার হলেন। কয়েক জন মতুয়া খালি পায়ে যাবার চেষ্ঠা করলে গরুগুলিও খাল পার হতে গেল। তাই দেখে গোস্বামী তাদের নিষেধ করে বললেন- তোরা ওপার থেকে হরিনাম কর। তাই শুনে গরুর পাল থেমে গেল। ওপার মানুষ এপার গরু। পশু ও মানুষে নৃত্যরত যেন কোন হুস নেই। কোলাকুলি, ঢলাঢলি, কাঁদা কাঁদি করে মতুয়ারা সবাই হরি বলছে। এর পর রাখালদের ফিরিয়ে দেয়া হল এবং যে যার গরু বেছে নেয়ে চলে গেল।
এরপর মতুয়ারা সবাই সাহাবাজপুর এলেন। তাঁদের কতকাংশ জয়পুর ও কুন্দসী গেলেন। মহানন্দ পাগল, অক্ষয় ঠাকুর, পূর্ণচন্দ্র, হরিশ্চন্দ্র তপস্বী পালের বাড়ি গেলেন। অর্ধরাত পর্যন্ত নাম সংকীর্তন হল। হুলধ্বনি ও হরিধ্বনিতে যেন সে বাড়ি মুখরিত হল। এর পর কীর্তন শেষ হল। সবাই যখন বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তখন বাঁক কাঁধে দুই গোয়ালা দধি নিয়ে আসেন। সেই দধি সহযোগে মহোৎসব হল। সকাল বেলা সবাই মিলে জয়পুরে সাধনার বাড়ি এলেন। এখানে এসেও সবাই নাম গানে মত্ত হন।
কুন্দসী নিবাসী দীননাথ পাল মতুয়া হয়েছিলেন। তাঁর ছিল রসপৈত্তিক ব্যধি। সেকারণে তাঁর মনে বড় কষ্ট। তাঁর স্ত্রী রাতে স্বপ্নে দেখেন জয়পুরের তারককে ধর্ম বাপ ডাকলে তাঁর ব্যাধি ভাল হয়ে যাবে। ধর্মবাপ ডাকার পর তাঁর ব্যাধি ভাল হয়ে যায়। সেই থেকে তিনি মতুয়া হন। তাঁর মানসিক মহোৎসব ছিল। মহানন্দ গোস্বামীকে অহহ্বান জানালে তিনি মতুয়াদের নিয়ে তাঁর বাড়িতে হাজির হন। কেউ কেউ এখন থেকে জয়পুর যান। এখানে মদন বিশ্বাসের মাধাই আবেশ, আর গোস্বামীর নিত্যানন্দ আবেশ হয়। তারকের হয় জগাই আবেশ। ভাবাবেশে তাঁরা নানা কথা বলেতে থাকেন। এক পর্যায়ে জগাই ও মাধাই আবেশ ধারী তারক ও মদন মহানন্দের পদতলে পড়েন। লোহাগড়া বাজারের দক্ষিণ দিকে এইসব লীলা হচ্ছিল। বাজারের লেকেরা এই ভাব দেখে তারাও হরি বলতে বলতে লাগলেন। তারপর মতুয়ারা সবাই তারকের বাড়ি গিয়ে কীর্তনে মেতে ওঠেন। গ্রামের নরনারীরাও ছুটে এসে কীর্তনে যোগ দিলেন। বহুক্ষণ কীর্তন হল। বিশ্রামান্তে সবাই আবার কুন্দসী দীননাথের বাড়িতে মহোৎসবে যোগ দেন। প্রেমানন্দের মধ্য দিয়ে মহোৎসব সুসম্পন্ন হল।
প্রোভারী মহানন্দের অলৌকিক লীলা:
রূপগী হার শোম্বানী মহালগ স্বরুপণ নিয়ে দিঘলিয়া গ্রামে আসেন। এখানে এসে ভক্তগণ মাদর জলের বাড়িতে এখানে আটাখানে যাবি ভোর লাম সংকীর্তনের পর সকালে ঘনিবেসে ভাল বাপর বাড়ি আসেন। এখানে আঠার ঘর পাল বাড়ি। সকালে শেখানে বালা দেয়াতে দিয়েছে আ এটি মহোৎসব হয়। তারপর সুক্তা গ্রামে পোলোক পালের বাড়ি। সে বাড়িতে রায়েন্স দুপুরে মানুয়ামের এবাদ কীর্তনে মহা ভাব হয়। আবের আবেশে ভক্তগণের মধ্যে ব্রঙ্গভাবের উদয় হয় দলে কেউ আমার হাতা যার। হঠাৎ দেখা গেল ভূমিতে পড়ে থাকা পোস্বামী মহানন্দের শরীর থেকে শোয়া কেয় আমার করল ঘরে একটা ঘরে দেয়া হল। তাঁর শরীরের লোম কূপ থেকে ক্রমাগত ধোঁয়া বের হচ্ছে। ধোয়ায় মর আজান হয়ে গেছে। ধোঁয়া উপরের দিকে উঠে পাচ্ছে। তাঁর শরীরের লোম ও চুল উর্দ্ধমুখী। উর্দ্ধ যার বইছে। না বর্তমান না ভবিষ্যৎ এমনি ভাব। মুখের মধ্যে রক্তিম বরণ সেখান থেকে আগুনের শিখা বের হচ্ছে। ঘরের মধ্যে ও বাইরে গোস্বামীকে ঘিরে সবাই হরিনাম করতে লাগলেন। ধীরে ধীরে তাঁর দিবর্ণ দেহ থেকে ঘুম দূরীভূত হল। এন্তে ব্যন্ডে তাঁর গায়ে তেল মেখে কোলে করে স্নান করান হল। তিনি সুস্থ হলেন। গোস্বামী সম্বিত ফিরে পেলে মনে হল যেন মৃত দেহে প্রাণ ফিরে এসেছে। মহানন্দ সাগলের এরূশ অলৌকিক ভাব দেখে সবাই বিমোহিত হলেন। এমন অত্যাশ্চার্য ঘটনা সত্যিই বিরল।
নীলা সাঙ্গন
* ১৩১৩ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসের প্রথম দিকে গোস্বামী মহানন্দের জ্বর দেখা দেয়। তালতলা নিবাসী হরিভক্ত উমাচরণ খবর পেয়ে তাঁকে দেখতে আসেন। তিনি গোস্বামীকে ঐকান্তিক ভক্তি করতেন। প্রণালিয়া গ্রামের শাস্তা নামে জনৈকা ভক্তা গোস্বামীকে ভক্তি করতেন। তাঁর শুশ্রূষার জন্য উমাচরণ | প্রভাকে নিয়ে আসেন। তিনি এসে গোস্বামীর অবস্থা দেখে কেঁদে গড়িয়ে যান। পরে তাঁর পরিচর্যার জন্য তিনি সেখানে থেকে যান। কিছুদিন সেবা অস্ত্রধা করে তিনি বাড়ি গেলে আসেন ধনগ্রাম নিবাসিনী প্রধামনি নামে এক ভক্তা। তাঁর সাথে সহযোগিতা করেন নড়াইলের গোপালের মা।
ক্রমে গোস্বামীর জ্বর বৃদ্ধি পায়। কোন কিছুতে জ্বর সারে না। এক রাতে বহু ভক্ত আসেন তাঁকে দেখার জন্য। সারারাত্রি তাঁরা হরিনাম করেন। এসব ভক্তদের মধ্যে ছিলেন- গোপাল বাড়ই, যাদব বিশ্বাস, রাধামনি, দীননাথ প্রমুখ। গোস্বামীর ভাই দশরথ বারবার মহেশকে বলেন হাতের নাড়ি দেখতে। ধীননাথ অবিরামভাবে আকুল হয়ে হরিনাম করছেন। গোস্বামী তাকে নাম ক্ষান্ত দিতে বললেও তিনি তা শোনেন না। তাঁর ইচ্ছা নামের দ্বারা তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবেন। দীন নাথ ছিলেন পাগলের একান্ত অনুগত ও অন্তরঙ্গ মানুষ। তিনি চলে গেলে দীননাথ কার সংগে চলবেন। অন্তর জেনে গোস্বামী তাঁকে বলেন- ওরে দীনে, আমাকে আর বেঁধে রাখিস না। এবার ছেড়ে দে ভাই। আমি আপন দেশে চলে যাই। শুনে দীননাথ দ্বিগুণ ভাবে হরিবলে কাঁদতে লাগলেন। যাদব বিশ্বাস, মহেশ এই দুই ভক্ত বার বার হাতের গাড়ি পরীক্ষা করতে থাকেন। এমন সময় ঘটল এক ঘটনা।
ঠাকর গুরুচাঁদ তখন কৃষ্ণপুর ছিলেন। তিনি শ্রীধামের উদ্দেশ্যে যাত্রাকালে সংগীদের বলছে আমার যে নারকেল বাড়ি হয়ে যেতে হবে। মহানন্দকে একবার দেখার ইচ্ছা হয়েছে। আমি ছাড়া সে জামাআর কেউ নেই। একথা শুনে সবাই সেইদিকে নৌকা চালাতে লাগলেন। এমন সময় মহাদয় পাগলের সামনে গোলোক পাগলের মূর্তি দেখা গেল। তিনি বললেন-
বলে ওরে মহানন্দ হৃদয় রতন। তোকে নিয়ে নিত্যধামে করিব গমন।। শ্রীশ্রী হ.গু.চ.সু.পৃ: ২২৭/২
কিছুক্ষণ পর গোস্বামী গোলোক অদৃশ্য হলেন। মহানন্দ ছট ফট করতে লাগলেন। হটাৎ ব্রহ্মরন্ধ যেদ করে প্রাণ বায়ু বের হয়ে গেল। ৩০ শে চৈত্র ১৩১৪ বঙ্গাব্দ (ইং ১৩ এপ্রিল ১৯০৮) মৃত্যুর কোলে ডিজি ঢলে পড়লেন। রাধামনি ও শান্তা দেবী তাঁর কানে হরিনাম দিলেন। এভাবে মহৎ জীবনের অবসান হল। ড়াচ্ছে খাঁরা ছিলেন তাঁরা কেঁদে হা হুতাশ করতে লাগলেন। খবরটি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে বহু লোর জড় হল। তাঁরা কেঁদে বুক ভাসালেন। নারকেলবাড়ি শোক সাগরে পরিণত হল। কে কাকে শান্ত্বন দুর্গাদেবী স্বামীর পায়ে মাথা কুটতে। দেবে। সবাই ভূমিতে পড়ে গড়াগড়ি যাচ্ছে। গোস্বামীর স্ত্রী দুর্গাে লাগলেন। শোকের মাতন উঠল। সকলে মিলে গোস্বামীর দেহ সৎকারের মনস্থ করলেন।
এদিকে ঠাকুর গুরুচাঁদ সুরগ্রামে এসে সবাইকে বললেন- আমি আর নারকেল বাড়ি যাব না। যা হবর হয়ে গেছে তোমরা শ্রীধামে ফিরে চল। তিনি কয়েকজন ভক্তকে পাঠিয়ে দিলেন পাগলের বাড়ি সৎকারের জন্য।
এরপর সবাই মিলে ডংকা শিঙ্গার বাদ্য ও হরিনামের মধ্য দিয়ে তাঁর মরদেহ সৎকার করলেন।
অশ্বিনী গোঁসাই
প্রেমিক কবি অশ্বিনী গোঁসাই এর জীবন কথা
বাগেরহাট জেলার চিতলমারী উপজেলাধীন গঙ্গাচর্ণা গ্রামের প্রেমিক কবি অশ্বিনী কুমার সরকার। তাঁর জন্ম ১২৮৪ বঙ্গাব্দ কার্তিক মাস (১৮৭৭ খ্রিঃ) বুধবার। পিতার নাম কার্তিক চন্দ্র বৈরাগী এবং মাতার নাম অম্বিকা দেবী। অতিশয় দরিদ্র পরিবারে অশ্বিনী গোঁসাই এর জন্ম। হরিচাঁদের ভক্ত গোলোক গোস্বামী এই বাড়িতে প্রায়ই যাতায়াত করতেন। তাঁর পিতা মাতা তাঁকে অত্যধিক ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন। তাঁদের বিয়ের পর নয় বছর গত হলেও কোন সন্তানাদি হয়নি বলে মনে খুব দুঃখ ছিল। একদিন গোস্বামী গোলোক তাঁদের বাড়ি এসে মা মা বলে অম্বিকা দেবীকে ডাক দেন। অম্বিকাদেবী কর্মান্তরে ছিলেন। ডাক শুনে তড়াতাড়ি ঘরে এসে দেখেন গোলোক গোস্বামী এসেছেন। তাঁকে দেখে তিনি মহা খুশী। তাঁর মধ্যে যশোদা ভাব উদয় হল। অমনি গোস্বামী গোলক মা মা বলে অম্বিকা দেবীর গলা ধরে স্তন দুগ্ধ পান করলেন। বললেন- এবার তুই গর্ভিণী হবি। তোর এক ছেলে হবে, নাম রাখবি অশ্বিনী। এই বলে তিনি রওনা হলেন। এর পর অম্বিকা দেবীর দেহে পরিবর্তন দেখা গেল। এভাবে দশ মাস গত হলে ১২৮৪ বঙ্গাব্দের কার্তিক মতান্তরে আশ্বিন মাস বুধবার পূর্ণিমা তিথিতে (স্বাতী নক্ষত্র) এক শুভক্ষণে অশ্বিনীর জন্ম হয়। সন্তান কোলে পেয়ে কার্তিক দম্পতি মহা খুশী। বাড়িতে শান্তির পরশ বয়ে যায়। এরপর থেকে গোলোক গোস্বামীর প্রতি তাঁদের আর্তি আরো বেড়ে যায়।
শিশু অশ্বিনী ছিলেন খুবই শান্তশিষ্ট। আড়াই বছর বয়সে তাঁর মা মারা যান। পিসিমার কোলে। তিনি লালিত পালিত হন। তাঁর পিতা পরে পুণর্বিবাহ করেন। পরে তাঁর আরো তিনটি পুত্র সন্তান হয়। তাঁরা হলেন যজ্ঞেশ্বর, পুলিন ও বিপুল। দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়া হলে তাঁর শিক্ষা গ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়। কারণ অতিশয় দরিদ্র হেতু তাঁর পিতা পড়ার খরচ চালাতে পারছিলেন না। এর পর তিনি সাংসারিক কাজে মন দেন। আট বছর বয়সে অভাবের তাড়নায় তিনি মামার বাড়ি চলে যান। সেখানে তিনি সকলের আদর স্নেহ পেলেও তাঁকে গরু রাখতে হত। দুই বছর পর তিনি সুধন্য পোদ্দার নামে জনৈক ব্যক্তির বাড়িতে মাসিক এক টাকা বেতনে কাজ নেন। কাজ ছিল মাঠে গরু রাখা। তিনি কাজে-ফাঁকি দিতেন না। প্রভাত হলেই তিনি গরু নিয়ে মাঠে যেতেন। গরুগুলি মাঠে চরে বেড়াত আর তিনি গাছ তলায় বসে থাকতেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় গরুগুলি কোন লোকের শষ্য নষ্ট করতো না। এক ক্ষেতের ঘাস খওয়া হলে তিনি গরুগুলোকে অন্য ক্ষেতে যেতে বললে তারা সেখানে গিয়ে ঘাস খেত। গরুগুলি তাঁকে খুব মান্য করতো। গরু ছেড়ে দিয়ে তিনি গাছের ছায়ায় বসে গুণ গুণ করে গান গাইতেন এবং হরিচাঁদ গুরুচাঁদ বলে হাই ছাড়তেন।
একদিন অশ্বিনী গরু ছেড়ে দিয়ে গাছতলায় পদ্মাসনে বসে গভীর ধ্যানে মগ্ন হলেন। হরিচাঁদকে স্মরণ করে তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। কেঁদে কেঁদে তিনি এক সময় ঐ বৃক্ষতলায় ঘুমিয়ে পড়েন। ভক্তজনকে সবাই ভালবাসে। অশ্বিনী গভীর ঘুমে মগ্ন হলে এক সময় তাঁর মাথার উপর রোদ এসে পড়ে। দৈবে এক অজগর সেখানে আসল। সে ভক্তকে চিনতে ভুল করল না। সে তার ফণা দিয়ে অশ্বিনীর মাথা ঢেকে রাখল। অশ্বিনী বহুক্ষণ বাড়ি আসেনা দেখে তাঁর মনিব তাঁকে খুঁজতে লোক পাঠালেন। তারা এসে ঐ অবস্থায় অশ্বিনীকে দেখে তাড়াতাড়ি গৃহস্বামীকে খবর দিল। ব্যস্তভাবে তিনি মাঠে ছুটে আসেন। ততক্ষণে অশ্বিনীর নিদ্রা ভঙ্গ হয়েছে। ফলে অজগরটিও চলে যায়। গৃহস্বামী এসে দেখেন কোথাও কিছু নেই কিন্তু অশ্বিনী বসে আছেন। তিনি বিপুল সমাদর করে তাঁকে বাড়ি নিয়ে গেলেন।
অশ্বিনীর জন্মের কিছুকাল পরে গোস্বামী গোলোক মারা যান। তাঁর শক্তি মহানন্দ গোস্বামীর উপর বর্তায়। সেদিনের ঐ ঘটনার পর অশ্বিনী নারকেলবাড়ি মহানন্দ গোস্বামীর বাড়ি চলে যান। মহানন্দ ভক্তালয়ে গেলে অশ্বিনীও সংগে যান। যেখানেই যান তিনি সেখানেই গান গান। তবে ভ্রমণকালীন সময়ের জন্য কৃষাণের কাজে বাধা হয়। এ জন্য কেউ তাঁকে রাখতে চন না। সেজন্য মহানন্দ পাগল বলেন-
অকেজো বলিয়া তারে সবে বাদ দেয়।
আমি দেখি 'বাদে' যদি কোন কাজ হয়।। শ্রীশ্রী ৩.চ.পৃ: ৪৯৬/২
অশ্বিনী আমার বাড়িতে কৃষাণ থাকবে। সেই থেকে তিনি নারকেলবাড়ি রয়ে যান। গুণ গুণ সুরে সব সময় গান করেন।
অশ্বিনীকে পেয়ে মহানন্দ পাগল খুব খুশী। তিনি তাঁকে ওড়াকান্দী শুরুচাঁদের কাছে নিয়ে যান। ঠাকুরকে দেখা মাত্র অশ্বিনী ঠাকুরের প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর ভাব দেখে ঠাকুর বলেন- আমার মস্ত মহানন্দকে পূজো কর, তাতেই তোমর সব হবে। স্বামী মহানন্দের উপর অশ্বিনীর ভার দেয়ায় তিনি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন। তারপর তিনি অশ্বিনীকে জয়পুরে তারক চন্দ্রের বাড়ি নিয়ে যান। অশ্বিনীকে দেখা মাত্র তারক চন্দ্রের মমতা হল। গোস্বামী তাঁকে জয়পুর রেখে দেন। তারপর অশ্বিনী ঐ বাড়িতে থেকে যান। গুণ গুণ করে গান করেন আর গৃহের কাজ কর্ম করেন। তাই দেখে তারক চন্দ্র খুব খুশী হন। তারক চন্দ্রের স্ত্রী চিন্তামনি দেবীও অশ্বিনী কে আপন পুত্রের মত দেখতেন।
এরপর কবিরসরাজ তারকচন্দ্র অশ্বিনীকে নিজের কবিগানের দলে নেন। তাঁর কণ্ঠে ছিল অপূর্ব সুর। সুর শুনে শ্রোতারা আনন্দ পেতেন। এখানেই তাঁর কবি গান শিক্ষা হয়। এভাবে দু'টি বছর কেটে যায়। কবিরসরাজ তাঁকে নিজের দল করে কবিগান করতে বলেন। তাই তিনি নিজেই দল করেন। কিছুদিন তিনি দুর্গাপুরে হরিবর সরকারের বাড়িতে থাকেন। তারপর তিনি দল নিয়ে বিভিন্ন স্থানে কবিগান গেয়ে বেড়াতেন।
এসময় তিনি কিছু কিছু গানও রচনা করেন। তাঁর গানের সুর, ছন্দ ও ভাব শুনে শ্রোতারা বেশ প্রেমানন্দ লাভ করতেন। একবার ঘটল এক ঘটনা। একবার কবির দল নিয়ে ঢাকা যাবার পথে পদ্মানদী পাড়ি দিতে গিয়ে তাঁর নৌকা ডুবে যায়। এতে তিনি খুব কষ্ট পান। বস্তুও অন্যান্য জিনিসপত্র যা খুয়ে গেছে তা কেনা তাঁর দুঃসাধ্য। অন্তর জেনে ঠাকুর গুরুচাঁদ সেটা দূর করেন। গান অন্তে বাড়ি ফেরার সময় পদ্মায় যেতে নৌকার মধ্যে নিজের বস্ত্র দেখতে পান। অন্য জিনিসপত্রও দেখতে পান। হারানো জিনিস ফিরে পেয়ে তিনি প্রেমে দ্রবীভূত হন। তারপর গান রচনা করেন-
কত দয়া করছ গুণের বলিহারি। শ্রীশ্রীহরি সংগীত
কিছুদিন কবিগান করে তিনি দল ভেঙ্গে দেন। যাঁর মনে ভক্তি ও প্রেম, যাঁর হয় স্বাত্বিক বিকার, ঠাকুরের প্রতি যাঁর সমর্পিত মন সে কি কখনও বাঁধা ধরা জীবনে চলতে পারেন। বাড়ি ফিরে তিনি গুরুরূপ সাগরে ডুবে থাকেন, সাংসারিক কর্ম ও হরিনামে মেতে থাকেন। মাঝে মাঝে সেই পোদ্দার বাড়ি গিয়ে মজুরী খাটেন। তাঁর গান ও ভাবে মুগ্ধ হয়ে সুধন্য পোদ্দার তাঁকে বলেন- তোমার কোন কাজ করতে হবেনা। জমির আলে বসে শুধু গান করবে। সেইমত অশ্বিনী গান করতেন। তাঁর গান শুনে পোদ্দার মশাই এর চোখ দিয়ে জল ঝরতো। তবে মজুরীটা তিনি দিতেন। এভাবে উন্মুক্ত পরিবেশে গান করায় তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটে। বিনা কর্মে তাঁকে মজুরী দেয়ায় অন্য মজুররা রাগ করতো। মালিক তাদের বুঝিয়ে বলতেন-
তোরাতো করিস মোর ক্ষেত্র পরিষ্কার।
ভক্তে নিড়ায় আমার হৃদয় মাঝার।।
তাই তাঁরে অর্থ দেই পরামার্থ আশে।
যদি কিছু ঘটে ভাগ্যে ভক্তের বাতাসে।। শ্রীশ্রী হরি গুরুচাঁদ ভক্ত চরিত পৃ: ১৯৫/১
অন্য কৃষাণরা বলতো তবে বাড়ি বসে গান করুক জমিতে বসে কেন?
তিনি উত্তর দেন-
গান শুনে দেহের জঙ্গল ছাপ হয়।
জমিতে গাহিলে গান ফসল বাড়ায়।। শ্রীশ্রী হ.গু.ভ.চ.পৃ: ১৯৫/১
পরে দেখা যায় অশ্বিনী যে ক্ষেতের আইলে বসে গান করেছিলেন সেটিতে বেশী ফলন হয়েছে।
বিবাহ ও সংসার যাত্রা:
তিনি বেশ কিছু গান রচনা করেন। কিছুদিন পর পিতামাতা তাঁকে বিবাহ দিতে মনস্থ করেন। কিন্তু অশ্বিনী রাজী হন না। স্বামী মহানন্দ ও তারকচন্দ্র তাঁকে বুঝিয়ে বলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি বিবাহে রাজী হয়ে কানন চক নিবাসী সঞ্জয় মন্ডলের কন্যা মালঞ্চ কুমারীকে বিবাহ করেন। বিবাহ করলেও সংসারের প্রতি তাঁর মন বসে না। চার বছর পর তাঁর একটি কন্যা সন্তান হয়, নাম রাখা হয় বিমলা। স্ত্রীর ঋণ শোধ করার পর সাধক কবি অশ্বিনীর নিশিদিন কাটে হরি গুণাগুণ করে। স্ত্রী সংসার কোন দিকেই তাঁর খোয়াল নেই। তাঁর ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা সবই হরি-গুরুচাঁদকে নিয়ে। এক একটি সংগীত রচনা করে তিনি নিত্য গুরুচাঁদের পায়ে অর্ঘ্য দেন। এটাই তাঁর সাধনা। গুরুচাঁদ বলতেন-
'ধানের তুল্য ধন নেই আর গানের তুল্য সাধন সেই।'
কাম-বাস্থাহীন সাধু হরিনামের মধু পান করলেও তাঁর স্ত্রী এতে মোটেই খুশী নন। স্বামীর কাছে তিনি একটি পুত্র সন্তান চান। সাধুজী বুঝান- ও সব চিন্তা বাদ দিয়ে হরি পদে মন দেও। পুত্র যদি একান্তই চাও তবে জন্মান্তরে পাবে। স্ত্রীর কথা- নারীসংগ করলে যদি ব্রত ভঙ্গ হয় তবে বিয়ে করলে কেন? সাধুজী বলেন- পুত্র কিংবা স্বামী এর কোনটা তুমি চাও? যদি পুত্র চাও তবে আমাকে বিদায় দেও। স্ত্রী তাতে রাজী নন। অশ্বিনী দুঃখ পেলেন। শেষপর্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি স্ত্রীর কথা রাখলেন। রচনা করলেন-
আপন বলিতে কেউ হলনা এই ভবে। যারে এত ভালবাসি সেও ডুবায় রৌরবে। শ্রীশ্রীহরি সংগীত
জীবনে বিতস্পৃহা ও দেহ ত্যাগের ইচ্ছা: স্ত্রীর ইচ্ছা পূরণ করে গোস্বামী হীরামন আর বাড়ি ফিরে আসেননি। অশ্বিনীও সেটা ভেবে তাঁর
জীবনের উপর বীতস্পৃহা হল। এ জীবন আর রাখবেন না বলে তিনি ঘর থেকে বের হলেন। জলে ডুবে মরবেন বলে মধুমতি নদীর ত্রিমোহনায় গিয়ে জলে ঝাঁপ দিলেন। সামনে এক শিকারী কুমীর মাথা উঁচু করেছিল। সে গোস্বামীকে ধরতে গেল। তিনিও কুমীরের সামনে এগিয়ে এলেন। ঠাকুরের লীলা বোঝা দায়। কুমীরও হরিভক্তকে চেনে। কয়েকবার এসেও সে ফিরে গেল। অশ্বিনীকে খেলো না। এর পর তিনি জলে ডুবে মরতে গেলেন কিন্তু ডুবতে পরলেন না, ভেসে উঠলেন। তারপর ভেসে ভেসে তেরখাদা গিয়ে এক মুচির বাড়িতে উঠলেন। সেখানে কিছুক্ষণ থাকলেন। তারা কিছু খাবার দিল তাই যেয়ে অনির্দিষ্টের পথে রওনা হলেন। কখনো জলে। কখনো হাঁটা পথে চলতে চলতে এক সময় তিনি বাদাবনে এসে উপস্থিত হলেন। বনের মধ্যে গিয়ে দেখেন একটি ফাঁকা ঘর। কোন লোকজন নেই। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে দেখে তিনি ঐ ঘরে রাত কাটাবেন বলে প্রবেশ করলেন। গভীর রাতে তিনি বসে আছেন এমন সময় একটি ছায়ামূর্তি এলো। অশ্বিনী তার দিকে চেয়ে দেখেন একটি ভয়ঙ্কর মূর্তি। ভাবলেন- এবার বুঝি তাঁর আশা পূরণ হবে। নিশ্চই ও আমাকে মারবে। ভালই হল। কিন্তু ছায়ামূর্তি বুঝতে পারল এই মহাজন হরিভক্ত। বললেন- এ গৃহ আমার। এখানেই আমি থাকি। আপনি ঐ ঘরে থাকায় ঘরে ঢোকার সাধ্য আমার নেই। তার কথা শুনে অশ্বিনী ঘর থেকে বের হয়ে গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করলেন।
কিছুপথ হাঁটার পর সামনে দেখেন এক বৃদ্ধা রমণী একটা বোঝা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি এতই বৃদ্ধা যে ঐ বোঝাটি নিতে তাঁর কষ্ট হচ্ছিল। তাঁকে দেখে ঐ বৃদ্ধা বলেন- আমি খুব বৃদ্ধা, এতবড় বোঝা বইতে পারছি না। যদি তুমি একটু সাহয্য করতে তবে আমার কষ্টটা একটু কমতো। দুঃখিণী নারী ভেবে অশ্বিনী সেটা নিজের মাথায় করে তাঁর পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগলেন। কিছুদূর যাবার পর বৃদ্ধা রামণী বললেন- বাবা, তুমি বেশ বষ্ট করেছ আমার জন্য। এবার কী বর নেবে তাই বল। অশ্বিনী মনে মনে ভাবলেন- যখন বর দিতে চাচ্ছে, এ নারী তো সামান্য নয়। বললেন- কী বর দেবেন আপনি? আমাকে বর দেয়া বৃথা হবে। শুনে বৃদ্ধা বললেন- তুমি যা চাও তাই দেব। ইন্দ্রের ইন্দ্রত্বও যদি চাও দিতে পারি। অশ্বিনী ভাবলেন- একথা বলছে কেন। ইনি নিশ্চই শিবের ঘরণী হবে। তাই বললেন- আমার চাইবার কী আছে? আমার জীবনের এই শেষ। এজনম তো বৃথা গেল। তবে যদি পুনর্জন্ম হয় হে মা আমাকে একটু হরি ভক্তি দিও, তাই তোমার কাছে হরিভক্তি চাই। বৃদ্ধা হেসে বললেন- ওটা দেবার সাধ্য আমার নেই বাবা। ওটা কোথায় পাব। আমিও আমার স্বামী এই দুই জন একটু হরিভক্তি পাবার আশায় ত্রিভুবনে ঘুরে বেড়াই। হরি ভক্তি যেখানে সেখানে পাওয়া যায় না। তবে আমি তার সন্ধান দিতে পারি। যদি হরিভক্তি চাও, তবে ওড়াকান্দী চলে যাও সেখানেই হরিভক্তি পাবে। এ কথা বলে তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
বৃদ্ধার কথা শুনে অশ্বিনী ভাবলেন- মহাব্রত নষ্ট করে এখানে এসেছি। এখন ওড়াকান্দী গিয়ে কী ভাবে ঠাকুরকে মুখ দেখাব? তাতে আর কাজ নেই। এই ভেবে তিনি পশ্চিম দিকে চললেন। কয়েকদিন চলার পর তিনি নবদ্বীপ এসে উপস্থিত হলেন। এখানে এসে মহাভাবে মত্ত হলেন। অপূর্ব সুরে গান করেন। তাঁর গান শুনতে বহু নরনারী এসে ফুড় হয়। গান শুনে কেউ কেউ ভাবে মুগ্ধ হন আবার কেউ কেউ প্রেমে দ্রবীভূত হন। অনেকেই বলেন- কোথা থেকে আপনি এসেছেন। কোথায় যার আছে পরিচয় শুনে নবদ্বীপবাসীরা তাঁকে খুব যত্ন করেন। অনেকে খেতেও দেন।।
মন যার উদাসী সে কি কখনও এক জায়গায় থাকতে পারে? দুই দিন পর সেখান থেকে তিনি বৃন্দাবনের পথে চললেন। বহু কষ্টে সেখানে পৌঁছে কুঞ্জ বনে আনমনে বসে আছেন। এমন সময় এক নারী এসে তাঁকে বললেন- শোন বাপ, তুমি যে কাজ করে অনর্থক মনস্তাপ করেছ তাতে কোন দোষ নেই। এটাইতো গৃহীর ধর্ম। ব্রতভঙ্গ হয়েছে বলে তুমি যেটাকে মহাপাপ ভাবছো প্রভু সেটা মাপ করেছেন। এবার তুমি ঘরে ফিরে যাও। আর কষ্ট পেয়োনা। যাঁর লোক তাঁর কাছে যাও। যাঁর জন্য এখানে এসেছো, সে মানুষ এখানে পাবেনা। তুমি দূরে যাওয়ায় গুরুচাঁদ কত ব্যথা পেয়েছেন? তিনি তোমাকে মনে মনে ডাকছেন। তাই বলি শীঘ্র তুমি তাঁর কাছে যাও। এই কথা বলে সেই বৃদ্ধা বাতাসে ভর করে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
রমণীর কথা শুনে অশ্বিনীর চৈতন্য হলো। অনুতাপে মন দগ্ধ হল। আহা কী ভুল করেছি আমি। তিনি ওড়াকান্দীর পথে রওনা হলেন। যতই এগিয়ে আসতে লাগলেন গুরুচাঁদের কথা স্মরণ করে নয়ন জলে তাঁর বক্ষ ভেসে যাচ্ছিল। মন এতটাই উচাটন হল যে, হৃদয়ের ধন গুরুচাঁদকে যদি কেউ কাছে এনে দিত তবে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেতেন। কোন দিকে তাঁর ভ্রুক্ষেপ নেই। চলছেন তো চলছেনই। এভাবে কিছুদিন চলার পর এক সময় তিনি শ্রীধামে এসে ঠাকুর গুরুচাঁদকে দেখে কেঁদে পায়ের উপর লুটিয়ে পড়লেন। ঠাকুর তাঁকে মধুর স্বরে বললেন- বল অশ্বিনী কোন দায় ঠেকে ঘর ছেড়ে বৃন্দাবনে গেলে? মনে মনে পাপ ভেবে কত কষ্ট পেয়ে মরতে গেছ। মরতে পরলে কই? পাপ করে কারো অনুতাপ জাগলে তার আর পাপ থাকেনা। এতটুকু পাপ করে কেউ মরতে যায়? ঠাকুরের কথা শুনে অশ্বিনী দগ্ধপ্রাণে শান্তি পেলেন। ধীরে ধীরে তিনি সুস্থ হলেন।
গুরুচাঁদের কাছে আসার পর কিছুদিন কেটে গেল। বৃন্দাবন থেকে ফেরার পথে তাঁর পা কেটে গিয়ে ক্ষত হয়েছিল। সেই ক্ষত এক সময় বৃদ্ধি হল। এদিকে শরীরও ক্ষীণ হতে ক্ষীণ হচ্ছিল। ভাবেলেন শেষদিন বোধ হয় ঘনিয়ে এসেছে। তাঁর অবস্থা দেখে নিকটস্থ লোক তাঁকে কেঁদে বলেন- আপনার অবস্থা দেখে কষ্ট পাচ্ছি। মনে যদি কোন ইচ্ছা থাকে তবে আমাদের বলুন। উত্তরে গোস্বামী বললেন- আমার মনে আর কোন ইচ্ছা নেই তবে একটা অনুরোধ, আমি মারা গেলে আমার দেহ নারকেল বাড়ি মহানন্দ পাগলের কাছে রেখে এসো। তাতেই আমি শাস্তি পাব। তারপর সাধক কবি অশ্বিনী গোঁসাই সকলকে কাঁদিয়ে একদিন অজানা দেশে চলে গেলেন। তারিখটা ছিল ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের ৩ রা আষাঢ়, বুধবার।
অশ্বিনী গোঁসাই এর জীবনের কিছু বিশেষ ঘটনা:
(১)
সাধক কবি অশ্বিনী সরকার যখন নারকেলবাড়ি থাকতেন তখন পার্শ্ববর্তী বাড়ির এক মহিলা স্বাম কাছে কু-প্রস্তাব নিয়ে আসেন। গুরুপদে অনুরক্ত গোস্বামী এ প্রস্তাবে খুবই রুষ্ট হন এবং তাকে শিক্ষ দেবার ইচ্ছা করেন। নাম গুণেই তাকে পার করতে হবে। পুনরায় সেই নারী এসে আবার প্রস্তাব হিংসে তিনি সম্মত হন। ঐ মহিলা আবার বিবাহিতা। তাই যেদিন তার স্বামী বাড়িতে থাকরে না সেদিন যত পাঠাতে বলেন। সেই নারী আনন্দ মনে বাড়ি ফিরে যায় এবং স্বামী দূরস্থানে গেলে গোস্বামীকে আসরে বলেন। অশ্বিনী আসলে সেই নারী তাকে শুতে বলে। তিনি বলেন- কিছুক্ষণ বসে গুটি কয়েক গান করর তারপর যেটা বল তাই শুনব। নারী রাজী হলে অশ্বিনী গান ধরেন। একটার পর একটা গান করেন। সুরে যেন উজানে বয়ে যায়। ভাবের তরঙ্গে রমণীর মন থেকে পাপের ময়লা দূর হয়ে যায়। কামতার চলে যায়। তার অনুতাপ আসে। মনে ভাবল- আহা কী পাপই না আমি করেছি সাধুকে কু-প্রস্তাব দিয়ে। আমি দুশ্চরিত্রা, অপবিত্রা, অভাগিনী। অনন্ত নরকে আমার স্থান হবে। এই ভেবে সেই রমণী কেঁদে গোঁসাইএর পায়ের উপর গিয়ে পড়ল। বলল- বাবা, দয়াকরে রক্ষা কর। তোমায় না চিনে আমি অপরাধ করেছি। তুমি আমার ধর্ম পিতা। এ পাপ থেকে আমাকে রক্ষা কর। সাধুজী বললেন- শোন মা, পাথ করে যদি মনে অনুতাপ জাগে তবে আর পাপ থাকেনা। পুনরায় আর যেন মনে ঐ কু-আশা না থাকে। স্বামীর পা ধরে তাকে সব বলে ক্ষমা চেয়ে নিও। আর সব সময় স্বামীপদে ভক্তি রেখো। আজ হতে পাদ চিন্তা ছেড়ে দেও। আর সবসময় দু'জন মিলে হরিনামে মেতে থাক। সেই থেকে সেই নারী গোস্বামীর পা ধরে মতুয়া হল।
(২)
সাধক কবি অশ্বিনী সরকার খুব দরিদ্র পরিবারের সন্তান একথা পূর্বেই বলেছি। পিতার মৃত্যুর পর তিনি কিছুদিন বাড়িতে ছিলেন। বারুণীর সময় প্রতি বছর তিনি শ্রীধামে যেতেন। লক্ষ্মীখালীর গোপাল সাধুরও দল নিয়ে ঐ সময় বারুণীতে যেতেন। মনে মনে ভাবতেন ঠাকুর বাড়ি যাবার সময় একজন হরিভক্তের সংগে যাবেন। তাই দল নিয়ে তিনি অশ্বিনীর বাড়িতে উঠতেন এবং তাঁকে সংগে নিয়ে ওড়াকান্দী যেতেন। ভক্তরা এলে অশ্বিনী কোন বাড়ি থেকে চাল, কোন বাড়ি থেকে ডাল, তেল, লবন এসব চেয়ে আনতেন। তাঁর দারিদ্রবস্থা দেখে সবাই জিনিসপত্র দিতেন।
একবার ঐ পথে গোপাল সাধু মতুয়া দল নিয়ে এলেন। সেই একই ভাবে গোস্বামী সব ভক্তকে খেতে দিলেন। সাধু মশাই (গোপাল সাধু) ভাবলেন, এবার ঠাকুর গুরুচাঁদের কাছে গিয়ে সব বলব। তাঁর মনোভাথ ঠাকুর একটু আর্শীবাদ করলে অশ্বিনীদার কোন অভাব থাকবে না। যাইহোক অশ্বিনী গোঁসাইকে নিয়ে সদলবলে গোপাল সাধু ঠাকুর বাড়ি এলেন। কয়েক দিন পর ঠাকুর ভক্তবৃন্দ নিয়ে বসে আলাপ আলাচনা করছিলেন। অশ্বিনী ও গোপাল সেখানে বসে ছিলেন। এসময় সাধুজী দাঁড়িয়ে বিনীতভাবে ঠাকুরকে বললেন- বাবা, অশ্বিনীদার নামে আমার একটা নালিশ। শুনে গুরুচাঁদ শিউরে উঠলেন। সে কি অশ্বিনীর মত ভক্তের নামে নালিশ। অন্য ভক্তরাও বিস্মিত হলেন। ঠাকুর অন্তরে সব জানলেও হসে বললেন- বল কী গোপাল? অশ্বিনীর নামে কী নালিশ জানাতে এসেছ? সাধুজী বলেন- হাবা, প্রতি বছর দল নিয়ে বারুণীতে আসি। ভাবি ঠাকুর বাড়ি যাবার সময় আমি জীতে হাব। তাই অশ্বিনীদার বাড়িতে আসি। আমরা গেলেই তিনি বিভিন্ন জনের বাড়ি থেকে চাল, ভাল প্রকৃতি চেয়ে আনেন। আপনি একটু বলে দিলেতো দাদার আর অভাব থাকেনা। ঠাকুর শুনে বললেন ওই কথা, আমি ভেবেছি অশ্বিনী যেন কি না কি করেছে। তা বেশ অশ্বিনী কী বল? জীর্ণ দীর্ণ কাঙ্গাল বেশধারী অশ্বিনী পাশে ছিলেন। দড়িয়ে বিনীত ভাবে বললেন- বাবা, আপনার দয়ায় চাইলে সাবাই সব কিছু দেয়। আপনি আশ্বির্বাদ করবেন, চাইলেও যেন লোকে কিছু না দেয়। আমি শুধু আপনাকেই চাই বাবা। অন্য কিছু চাই না। ঠাকুর পুনরায় বললেন- গোপাল, তুমি কী বল? সাধু মশাই অশ্বিনীর মনোভাব বুঝতে পেরে কেঁদে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। আর বললেন- বাবা, আমি অশ্বিনীদার ভাব আগে বুঝতে পরিনি। আমায় ক্ষমা করুন। তাঁর সংগে অশ্বিনীও গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। পরে গান ধরলেন-
তোমাকে বাসিব ভাল এই ভিক্ষা চাই।
আমায় বাসবা না বাস ভাল, তাতে কোন ক্ষতি নাই।
তোমাকে বাসিব ভাল এই ভিক্ষা চাই।।-------শ্রীশ্রী হরিসংগীত
অন্যান্য ভক্তরাও চোখের জলে ভাসলেন। সেখানে এক মহাভাবের ঢেউ বয়ে গেল। ঠাকুর গুরুচাঁদ অশ্বিনীকে যে ধন দান করেছেন তার উপরে কিছু নেই।
(৩)
ভক্তের বোঝা কী ভাবে ঠাকুর গুরুচাঁদ বহন করলেন তারই একটি ঘটনা এখানে তুলে ধরছি। একবার বারুণীর সময় গোপাল সাধু দল নিয়ে অশ্বিনীর বাড়িতে এলেন। তাঁকে পেয়ে অশ্বিনী খুবই আনন্দিত। যেন বাহা স্মৃতি নেই। ভক্তরা হরিনাম করছে আর অশ্বিনী ভিক্ষা করতে বের হলেন। কারণ ঘরে ভক্তদের ভক্ত সেবার জন্য কিছুই নেই। যে যে বাড়ি গেলেন সবাই ফিরিয়ে দিল। বেশ কয়েক বাড়ি গিয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে এলেন। কেউ কিছু দিলনা। কেউ কেউ নিন্দাবাদও করল। শূণ্য হাতে বাড়ি ফিরলেন তিনি। এখন কী করবেন। মুখে হরিনাম, চোখে প্রেমবারি। মনে মনে ঠাকুরকে ডাকতে লাগলেন। বাবা গুরুচাঁদ তুমি অকুলের কান্ডারী, বিপদের বন্ধু, বিপদে রক্ষা কর তুমি দয়াল।
এমন সময় চেয়ে দেখেন আকাশে ভীষণ মেখ। যে কোন মুহূর্তে ঝড় উঠবে। এদিকে ঘরে ছাউনী নেই। ঝড় বৃষ্টি হলে ভক্তরা কোথায় দাঁড়াবে? খেতে দিতে না পারলেও থাকতে তো দিতে হবে ভক্তদের। অশ্বিনী কোন উপায়ন্তর না দেখে মধুমতি নদীর কুলে এক বটবৃক্ষের তলে বসে কাঁদতে লাগলেন। কেঁদে কেঁদে বললেন- বাবা গুরুচাঁদ আজ কী বিপদ এসে হাজির হল। ভক্তবৃন্দকে এখন কোথায় রাখি, কি খেতে দেই? এর চেয়ে আমার মৃত্যু ভাল। এদিকে প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ওড়াকান্দী ঠাকুর বাড়িতেও তখন ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে। ভক্তের দুঃখ সইতে না পেরে ঠাকুর গুরুচাঁদ এক ভক্তকে তাড়াতাড়ি একটা ছাতা আনতে বললেন। ঠাকুর গদিঘরে বসেছিলেন। ছাতা নিয়ে এলে ঠাকুর সেটি মেলে মাথার উপর ধরলেন। কিছুক্ষণ ধরে রাখার পর তিনি ছাতাটি বন্ধ করলেন। সেদিন বেশ কিছুক্ষণ বঝড় বৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় গঙ্গাচর্নায় অশ্বিনীর বাড়িতে কিছুই হয়নি। অথচ পার্শ্ববর্তী গ্রামে ঝড় বৃষ্টি হয়ে বহুত ক্ষতি হয়েছিল। ছাতা ধরে গুরুচাঁদ সবাইকে রক্ষা করলেন, আর অশ্বিনীর মানও রাখলেন।
ঝড় বৃষ্টি শেষ হলে ভক্তরা ঠাকুরের ছাতা মেলে ধরার কারণ জিজ্ঞাসা করলে ঠাকুর বলেন- ভক্তেরা দায় ঠেকালে এমনি দশা হয়। ভবের মুটে সেজে ভক্তের ভার নিয়েছি, এখন কোথায় যাই বলতো? অশ্বিনী আমাকে ভক্তিডোরে বেঁধেছে, কি করে সে বাঁধন ছিড়ি? তাই তার বাসনা পূরাতে হলো। তার বাড়িতে বহু ভক্ত এসেছে, ঘরে এক মুষ্টি চাল নেই। এদিকে ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে। ভক্তরা কী খাবে, কোথায় দাঁড়াবে? সেতো আমাকে কিছু দিতে বাকী রাখেনি। যে আমাকে সব দেয় তার বোঝাতো আমার বইতে হবে। এমন দয়ার কথা শুনে ভক্তরা কেঁদে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন।
এদিকে অশ্বিনী বৃক্ষমূলে বসে কাঁদছেন। মন তার গুরুপদে নিবিষ্ট। এমন সময় লক্ষ্য করলেন ঝড় বৃষ্টি থেমে গেছে। মেঘ উড়ে গেছে আকাশ থেকে। গুরুচাঁদ বুঝি বাঁচালেন। থাক, ভক্তরা অন্ততঃ একটু মাথা গুঁজতে পারবে কিন্তু খেতে দেব কী ভাবে। ভিক্ষায় গিয়েতো কিছুই পেলাম না। খেতে দিতে না পারলে অখ্যাতি রটে যাবে। এসব চিন্তায় রাত হয়ে গেল। এবার ভক্তদের আহার জোগাতে কৃপাকরে গুরুচাঁদ এগিয়ে এলেন। তাঁর ভাব বোঝা দায়।
রঘুনাথপুর গ্রামের দিগ্বিজয় নামে জনৈক চালের ব্যাপারী তিনটি নৌকা বোঝাই চাল নিয়ে
চিতলমারীর হাটে যাচ্ছিলেন। কাটাখাল পার হয়ে মধুমতি নদীতে তার নৌকা সহসা আটকে যায়। মাঝ নদীতে নৌকা আটকে যাওয়ায় তারা ভীষণ বিপদে পড়ে গেলেন। বহু চেষ্টা করেও নৌকা চালাতে পরলেন না। লগি নিয়ে দেখা গেল নাদীতে বেশ জল অথচ নৌকা চলছে না। এক সময় তীরে বসে এক বৃদ্ধলোক ডেকে বলছেন- ওহে দিগ্বিজয়, এক বস্তা চাল নিয়ে তাড়াতাড়ি অশ্বিনীর বাড়ি দিয়ে এসো। বহু ভক্ত এসেছে অশ্বিনীর বাড়ি। একথা শুনে দিগ্বিজয় এক মাঝিকে দিয়ে এক বস্তা চাল পাঠালেন, সংগে নিজেও গেলেন। অন্ধকার রাত, সে ব্যক্তি পথঘাট চেনেনা। অশ্বিনীর নাম শুনেছে কিন্তু বাড়ি চেনেনা। হটাৎ তার লক্ষ্য পড়ল বট গাছের দিকে একটি লোক বসে আছে। তার কাছে গিয়ে বলল- অশ্বিনীর বাড়ি কোথায় আমাকে একটু দেখিয়ে দেওতো। তার বাড়ি এই চা'ল দিতে হবে। ব্যাপারীর কথা শুনে লোকটি ভূমিতে গড়াগড়ি দিয়ে বললে- আমি সেই অভাগা অশ্বিনী। ওহোরে গুরুচাঁদ, তুমি কত দয়াল। আমি ভিক্ষা করে চা'ল পাইনি বলে তুমি চাল পাঠিয়ে দিয়েছো। তুমি সবই দিয়েছো, তবু আমি বৃথাই চিন্তা করছি। আজ বিপদ কালে দিগ্বিজয়ের কাছে চাল পাঠালে দয়াল। অশ্বিনীর কান্না দেখে এবং তার কথা শুনে দ্বিগ্বিজয় সহ ব্যাপারীর চোখে জল এল। তারাও কেঁদে অশ্বিনীর পায়ের উপর পড়লেন। বললেন- তোমার মত ভক্ত আর কে আছে? গুরুচাঁদ বৃদ্ধ সেজে আজ আমাকে চাল দিতে বললেন। যা কিছু হল সবই তোমার ভক্তির গুণে। না হলে অথৈ জলে কারো নৌকা আটকে যায়? এর পর দ্বিগ্বিজয় আর হাটে গেলেন না। অন্যান্ন দের হাটে পাঠিয়ে দিলেন। সেদিন হাটে গিয়ে তাঁর বহুলাভ হয়েছিল। বার ঘটল আর এক ঘটনা। ঐ গ্রামের একটি লোক পাটগাতির হাটে গিয়েছিল। হাট করা হলে প্রবল ঝাড় বৃষ্টির কারনে এক দোকান ঘরে আশ্রয় নেয়। কোথা থেকে একে দিয়েছিলনে আমেনা মাথায় তার এক ঝুড়ি বেসাতি। সেই বৃদ্ধ সেখানেই আশ্রয় নেয়। লোকটিকে বদ্ধ সেখানে আসেন। বাড়ি যাব। তার জন্যই এই বেসাতি করেছি কিন্তু ঝড়ের জন্য যাওয়া হল না। এখন কী করি? আপনার বাড়ি কোথায়? লোকটি বলল যে তার বাড়িও গঙ্গাচর্ণায়, অশ্বিনীর বাড়ির কাছেই। শুনে তিনি বললেন-অনেক রাত হয়েছে। বহু দূরে আমার বাড়ি। গঙ্গাচর্ণায় গেলে আর বাড়ি ফিরতে পারবোনা। তাই দয়াকরে এই বেসাতিগুলি যদি নিয়ে যাও তবে খুব উপকার হয়। কারণ তাঁর বাড়িতে মহোৎসব হবে। বহু ভক্তরা এসেছে। এসব নিয়ে পাক করে তাদের খাওয়ানো হবে। এই টুকু শ্রম যদি তুমি দেও তবে তোমার কল্যাণ হবে। গঙ্গাচর্ণা নিবাসী লোকটি জানতো অশ্বিনীর বাড়িতে আজ ভক্তরা এসেছে। তাই বৃদ্ধের কাছ থেকে বেসাতিগুলি নিয়ে সে গঙ্গাচর্ণা গেল। বৃদ্ধাটিও অন্য পথ ধরে চলে গেলেন।
বাড়িতে এসে সেই ব্যক্তি অশ্বিনীকে বলল- একটি লোক আমাকে দিয়ে এই সব বেসাতি পাঠিয়ে দিয়েছে। ঝড় বৃষ্টির কারণে লোকটি আসতে পারেনি। ভক্তরা খাবে তাই আমি নিজে নিয়ে এসেছি। এদিকে অশ্বিনীও দ্বিগ্বিজয়ের দেয়া চাল নিয়ে বাড়িতে এসে দেখেন এই সব বেসাতি নিয়ে এসেছে। দু'জন তখন ভাবে উন্মত্ত হয়ে উভয় উভয়কে ধরে কেঁদে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। অন্য ভক্তরাও প্রেমাসিক্ত হলে ভাবের বন্যায় আর হরিনাম সংকীর্তনে রাত অতিবাহিত হল। গুরুচাঁদ বলতেন 'জগত ভরা যার গোলা, ভাতে মরেকি তার পোলা'। আজ সেটাই প্রমানিত হল। গুরুচাঁদ যাকে দয়া করেন তার কি কোন অভাব থাকতে পারে? অশ্বিনী গুরুচাঁদকে বলেছিলেন- বাবা, তোমার দয়ায় সবাই দেয়, এখন থেকে চাইলেও যেন কেউ কিছু না দেয়। তার প্রমাণ হাতে হাতেই মিলল।
ভোরবেলা প্রভাতী গান শেষ হল। গ্রামবাসীরা এসে বিভিন্নভাবে কাজ করলেন। রান্নাবান্নাও শেষ। ভক্তরা স্নান করে আসলেন। ভোজনের জন্য সবাই ব্যস্ত। এমন সময় ডঙ্কা বাজিয়ে আর একদল মতুয়াভক্ত এসে হাজির। তারাও মহোৎসবে যোগ দিলেন। সুস্বাদু প্রসাদ পেয়ে ভক্তরা আনন্দিত। এর পর দল সহ গোপাল সাধু ও অশ্বিনী গোঁসাই শ্রীধামে গেলেন। দ্বিগ্বিজয়ও গেলেন। গদিঘরে গিয়ে দিগ্বিজয় ঠাকুরের হাতে পাঁচ টাকা প্রণামী দিলে ঠাকুর তাঁকে বলেন- ওহে দিগ্বিজয়, তোমার তো খুক কষ্ট হয়েছে তাই না।? এজন্য মনে কষ্ট নিওনা। আমার একটা কথা পালন করো তোমার দিগুণ লাভ হবে। প্রতি বছর মহাবারুণীর পূর্ব দিনে অশ্বিনীর বাড়িতে এক বস্তা চা'ল ও কিছু বেসাতি দিও। সেই থেকে দিগ্বজয় ঠাকুরের বাক্য পালন করে চাল ও বেসাতি অশ্বিনীর বাড়িতে পাঠাতেন। তাঁর পুত্র পৌত্ররাও সেই ধারা আজও অব্যহত রেখেছেন। প্রতিবছর অশ্বিনীর বাড়িতে হাজার ভক্ত সমাগম হয় কোন কিছুর আয়োজন থাকেনা অথচ কোথা থেকে কে যেন চাল, ডাল, তারিতরকারী পাঠায় তা কেউ জানে না। গ্রামবাসীরাও এখন বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করেন। গুরুচাঁদের বহু একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন কিন্তু অশ্বিনীর মত এমন অহৈতুকী ভাবের ভক্ত বিরল।
এবার ঘটল আর এক ঘটনা। ঐ গ্রামের একটি লোক পাটগাতির হাটে গিয়েছিল। হাট করা হলে প্রবল ঝড় বৃষ্টির কারনে এক দোকান ঘরে আশ্রয় নেয়। কোথা থেকে হাটে দিয়েছিলানে অি মাথায় তার এক ঝুড়ি বেসাতি। সেই বৃদ্ধ সেখানেই আশ্রয় নেয়। লোকটিকে বন্ধ সেখানে আসেনর বাড়ি যাব। তার জন্যই এই বেসাতি করেছি কিন্তু ঝড়ের জন্য যাওয়া হল না। এখন কী করি? আপনার মাড়ি কোথায়? লোকটি বলল যে তার বাড়িও গঙ্গাচর্ণায়, অশ্বিনীর বাড়ির কাছেই। শুনে তিনি বললেন-অনেক রাত হয়েছে। বহু দূরে আমার বাড়ি। গঙ্গাচর্ণায় গেলে আর বাড়ি ফিরতে পারবোনা। তাই দয়াকরে এই বেসাতিগুলি যদি নিয়ে যাও তবে খুব উপকার হয়। কারণ তাঁর বাড়িতে মহোৎসব হবে। বহু ভক্তরা এসেছে। এসব নিয়ে পাক করে তাদের খাওয়ানো হবে। এই টুকু শ্রম যদি তুমি দেও তবে তোমার কল্যাণ হবে। গঙ্গাচর্ণা নিবাসী লোকটি জানতো অশ্বিনীর বাড়িতে আজ ভক্তরা এসেছে। তাই বৃদ্ধের কাছ থেকে বেসাতিগুলি নিয়ে সে গঙ্গাচর্ণা গেল। বৃদ্ধাটিও অন্য পথ ধরে চলে গেলেন।
বাড়িতে এসে সেই ব্যক্তি অশ্বিনীকে বলল- একটি লোক আমাকে দিয়ে এই সব বেসাতি পাঠিয়ে
দিয়েছে। ঝড় বৃষ্টির কারণে লোকটি আসতে পারেনি। ভক্তরা খাবে তাই আমি নিজে নিয়ে এসেছি। এদিকে অশ্বিনীও দ্বিগ্বিজয়ের দেয়া চাল নিয়ে বাড়িতে এসে দেখেন এই সব বেসাতি নিয়ে এসেছে। দু'জন তখন ভাবে উন্মত্ত হয়ে উভয় উভয়কে ধরে কেঁদে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। অন্য ভক্তরাও প্রেমাসিক্ত হলে ভাবের বন্যায় আর হরিনাম সংকীর্তনে রাত অতিবাহিত হল। গুরুচাঁদ বলতেন 'জগত ভরা যার গোলা, ভাতে মরেকি তার পোলা'। আজ সেটাই প্রমানিত হল। গুরুচাঁদ যাকে দয়া করেন তার কি কোন অভাব থাকতে পারে? অশ্বিনী গুরুচাঁদকে বলেছিলেন- বাবা, তোমার দয়ায় সবাই দেয়, এখন থেকে চাইলেও যেন কেউ কিছু না দেয়। তার প্রমাণ হাতে হাতেই মিলল।
ভোরবেলা প্রভাতী গান শেষ হল। গ্রামবাসীরা এসে বিভিন্নভাবে কাজ করলেন। রান্নাবান্নাও শেষ। ভক্তরা স্নান করে আসলেন। ভোজনের জন্য সবাই ব্যস্ত। এমন সময় ডঙ্কা বাজিয়ে আর একদল মতুয়াভক্ত এসে হাজির। তারাও মহোৎসবে যোগ দিলেন। সুস্বাদু প্রসাদ পেয়ে ভক্তরা আনন্দিত। এর পর দল সহ গোপাল সাধু ও অশ্বিনী গোঁসাই শ্রীধামে গেলেন। দ্বিগ্বিজয়ও গেলেন। গদিঘরে গিয়ে দিগ্বিজয় ঠাকুরের হাতে পাঁচ টাকা প্রণামী দিলে ঠাকুর তাঁকে বলেন- ওহে দিগ্বিজয়, তোমার তো খুব কষ্ট হয়েছে তাই না।? এজন্য মনে কষ্ট নিওনা। আমার একটা কথা পালন করো তোমার দিগুণ লাভ হবে। প্রতি বছর মহাবারুণীর পূর্ব দিনে অশ্বিনীর বাড়িতে এক বস্তা চা'ল ও কিছু বেসাতি দিও। সেই থেকে দিগ্বজয় ঠাকুরের বাক্য পালন করে চাল ও বেসাতি অশ্বিনীর বাড়িতে পাঠাতেন। তাঁর পুত্র পৌত্ররাও সেই ধারা আজও অব্যহত রেখেছেন। প্রতিবছর অশ্বিনীর বাড়িতে হাজার ভক্ত সমাগম হয়। কোন কিছুর আয়োজন থাকেনা অথচ কোথা থেকে কে যেন চাল, ডাল, তারিতরকারী পাঠায় তা কেউ জানে না। গ্রামবাসীরাও এখন বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করেন। গুরুচাঁদের বহু একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন কিন্তু অশ্বিনীর মত এমন অহৈতুকী ভাবের ভক্ত বিরল।
(8)
গোপালগঞ্জ সদরে অবস্থিত ওলপুর গ্রাম। সেই গ্রামে উপেন্দ্রে মিত্র নামে এক বাক্তি ছিলেন। তিনি কায়স্থ জাতির লোক। লেখাপড়া শিখে তিনি ডেপুটির চাকরী নিয়ে ফরিদপুর সদরে থাকেন। স্ত্রীর নাম মিনতি এবং তিনি শিক্ষিতা। স্বামী স্ত্রী মিলে সরকারী কোয়ার্টারে থাকেন। প্রাচুর্যের সংসারে দুঃদ একটাই- নিজেদের কোন সন্তানাদি নেই। বহু ডাক্তার, কবিরাজ, ফকির ওঝা দেখিয়েও কোন সুফল পাননি। সন্তানের জন্য ঠাকুরের কাছে কত মানত করেছেন কিন্তু কোন কাজ হয়নি। এভাবে বহু বছর গত হয়। উপেন বাবুর বয়স পঞ্চাশ পার হয়েছে।
গোস্বামী অশ্বিনী প্রায়ই প্রতি বুধবার শ্রীধামে যেতেন। এটা যেন তাঁর নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে ওলপুর হয়ে যেতেন। একদিন ঐপথে যাবার সময় তাঁর খুব পিপাসা হয়। তিনি জলপানের আশায় উপেন বাবুর বাড়িতে আসেন। মিনতি রাণীকে দেখে গোস্বামী বলেন- মা, একটু জল দেও, বড্ড পিপাসা হয়েছে। গোস্বামীর মুখে মা ডাক শুনে মিনতির চোখে জল এলো। বুকে ব্যথা বাজল। কোথায় ঠিকানা জানা নেই। এই গোঁসাই কেন তাঁকে মা বলে ডাকল। অন্তরে ব্যথা তবুও হাসি মুখে জল এনে দিলেন। সেদিন ডেপুটি বাবুও ঘটনাচক্রে বাড়িতেই ছিলেন। স্ত্রীকে বললেন- শুধু জল দেবে কেন একটা ফলও কেটে দেও। চৈত্র মাসের দিন, পিপাসার্থ গোস্বামী তৃপ্তি সহকারে ফলও খেলেন। ডেপুটি বাবু অশ্বিনীকে একটা সিগারেটও দিলেন। গোঁসাই বরাবরই ধূমপান করতেন। সিগারেটটি পেয়ে আনন্দে ধুমপান করলেন। একটু পরে তিনি চারিদিক তাকিয়ে বলেন- বাড়িতে তো কোন ভাই বোনকে দেখছিনা ? তারা কেথায়? কথা শুনে স্বামী-স্ত্রী দু'জনই বললেন- এখানেইতো আমাদের দুঃখ। অর্থ বিত্ত থাকলেও সন্তানের অভাবে মনে শান্তি নেই। তাদের মুখে করুণ বাক্য শুনে গোঁসাই বলেন-এবার তোমাদের ছেলে হবে। আমার সাথে তোমরা ওড়াকান্দী চল। গুরুচাঁদের দয়ায় এবার সুফল ফলবে। তাঁর কথা শুনে দু'জনের মনে আশার সঞ্চার হল। মনের মধ্যে ভক্তির উদয় হল।
কথামত পরের বুধবার তাঁরা গোঁসাই এর সংগে ওড়াকান্দী গেলেন। পথে শুরুচাঁদ সম্পর্কে অশ্বিনী বহু কথা বললেন। শ্রীধামে গিয়ে গুরুচাঁদকে প্রণাম করে অশ্বিনী বললেন- বাবা, এদর মনে খুব দুঃখ। এদের একটা পুত্র সন্তান দিয়ে দুঃখ ঘুচিয়ে দেও। শুনে গুরুচাঁদ রেগে বললেন- আমি কেন আমার বাবার সাধ্য নেই যে এদের পুত্র সন্তান দেবে। এই বলে চুপ করে রইলেন। শুনে অশ্বিনীর খুব রাগ হলো। বললেন- এদের যদি সন্তান না দেও তবে তোমার অশ্বিনীও আর ধামে আসবে না। এই বলে তিনি দু'জনকে সংগে নিয়ে কামনা সাগরে স্নান করিয়ে হরি মন্দিরে প্রণাম ও মানত করিয়ে বাড়িতে চলে এলেন। তাঁদের বললেন- অবশ্যই এবার তোমাদের সন্তান হবে। তিনি কিছু নিয়ম পালন করতে বললেন। সেইমত তাঁরা সবই পালন করলেন। ঠাকুরের কৃপায় এবং অশ্বিনীর বরে বৎসরান্তে তাদের একটা ছেলে হল। পুত্র মুখ দেখে মিনতি রাণী আনন্দিতা। ডেপুটি বাবু বাড়িতে ছিলেন না। সুখবর শুনে বাড়িতে এলেন। এবং গোঁসাইকে সংবাদ জানালেন। অশ্বিনীও শুনে আনন্দ পেলেন।
এতদিন অশ্বিনী শ্রীধামে যাননি। এবার আনন্দ মনে শিশুসহ সবাইকে নিয়ে ওড়াকান্দী এলেন। শিশুটিকে ঠাকুরের পায়ের কাছে রেখে তারা প্রাণাম করলেন। নয়ন জলে সবার বুক ভেসে গেল। গুরুচাঁদ ভাব দেখে খুশীমনে বললেন- তুমি কাজ কর আমার বাবার মত। আমার কথায় যা হয়না তোমার কথায় তাই হয়। শুনে অশ্বিনী ধূলায় গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। উপেন বাবু ও মিনতিও কেঁদে আকুল হলেন। ঠাকুর তাঁদের বলেন- এখন থেকে দু'জন এক মনে এক ভাবে থেকে শ্রীহরিকে স্মরণে রেখ। তিনিই সব। তাঁর দয়ায় সবই হয়। এরপর ঠাকুর শিশুটি নিজ হাতে তুলে নিয়ে মায়ের কোলে দিলেন।
(৫)
শ্রীমৎ অশ্বিনী গোঁসাই এর সাধনাই ছিল সংগীতের মাধ্যমে। জীবনে তিনি বহু গান রচনা করেছেন। এপর্যন্ত তাঁর ১৮১টি গান 'শ্রী হরি সংগীত' এ ছাপা হয়েছে। অযত্ন আর অবহেলায় বহু গান নষ্ট হয়ে গেছে। সেগুলি আর কোনদিনই ফিরে পাওয়া যাবে না। তাঁর সংগীতরাজী সাহিত্য জগতের এক মূল্যবান সম্পদ। বিভিন্ন পরিবেশে ও ভাবের মধ্য দিয়ে তাঁর গান গুলি রচিত হয়েছে।
একবার শ্রীধাম ওড়াকান্দীতে ঠাকুর গুরুচাঁদ ভক্তবৃন্দ সংগে নিয়ে বসে আছেন। অশ্বিনীও ঠাকুরের কাছাকাছি বসে আছেন। গুণ গুণ করে সুর আওড়াচ্ছেন। ঠাকুর তাঁকে গান গাইতে বললেন। একটার পর একটা গান করছেন আর শেষ হলেই ঠাকুর বলছেন- গাও আরও গাও। তিনি গেয়ে চলেছেন।
এক সময় তিনি গাইলেন-
পথ ছাড়রে ছয়জন বাদী আমি দেখব হরি গুণনিধি।
এই গান শেষ হলে ঠাকুর বলেন- অশ্বিনী এই গানের উত্তর দেও দেখি। অশ্বিনী বলেন- বাবা একটু ঘুরে আসি। তিনি কিছুক্ষণ ঘুরে এসেই গান ধরলেন-
কে বলেরে রিপু ছয় জন।
তারা ভজন পথের মূল মহাজন।
শুনে ঠাকুর বলেন- বেশ ভালই গেয়েছ অশ্বিনী। এভাবে তিনি বিভিন্ন সময় ও বিভিন্ন ভাবে বহু গান রচনা করেছেন। এই গান দিয়ে তিনি গুরুচাদের পায়ে অর্ঘ্য দিয়েছিলেন। তাঁর রচিত সংগীত পুস্তকের নাম 'শ্রী হরি সংগীত'। এখনো ভক্তরা তাঁর রচিত গান গুলি গেয়ে ভাবে প্রেমে অপুত হন। শ্রোতারাও আনন্দসাগরে ভাসতে থাকেন।
হরি ভক্ত দেবীচাঁদ গোস্বামী এর জীবন কথা
গুরু চাঁদের ভক্তদের মধ্যে দেবীচাঁদ গোঁসাই অন্যতম। পুরানাম দেবীচাদমন্ডল। আদি নিবাস গোপালগঞ্জ জেলার পাটগাতি গ্রামে। পরে তিনি বরিশাল জেলার বানিয়ারী গ্রামে বসতি নেন। বয়ঃক্রমে পাটগাতি এক ধনী সম্মানিত গাতিদার এর বাড়িতে গোমস্তা হিসেবে চাকরী করেন। কাজকর্মে তিনি ছিলেন বিচক্ষণ দক্ষতা সম্পন্ন ব্যক্তি। উপরে তাঁকে কঠিন দেখালেও মনটা ছিল ফুলের মত কোমল। শরীরাটা যেন অষ্টধাতু দিয়ে গড়া।
প্রতিবছর শারদীয় দুর্গাপূজার সময় ঐ বাড়িতে কবিগান হতো। সেখানে কবিরসরাজ তারকচন্দ্র সরকার কবি গান করতেন। তাঁর গান শুনে তাঁর মনে হল তারকের মধ্যে যেন একটা অদৃশ্য শক্তি রয়েছে। তিনি অন্য এক জগতের মানুষ। তা না হলে হরিনাম করার সংগে সংগেই তাঁর চোখ দিয়ে জল বের হয় কেন? তাঁর মনে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। একদিন তিনি সরাসরি তারকের কাছে জিজ্ঞাসা করেন- দিবানিশি আপনি কেন হরিচাঁদ, গুরুচাঁদ আর হরি বলেন? কোন ভাবে আপনার চোখ ভরে জল আসে? দোবীচাঁদের কথায় তারকের মন আকুল হল। শ্রীহরিকে স্মরণ করে অবিরল ধারায় চোখ দিয়ে জল ঝরতে লাগল। ক্ষণকাল পরে দেবীচাঁদকে বললেন- শোন দেবীচরণ হরিবলে আমার নয়ন ঝরে না। শ্লেষ্মা বৃদ্ধিজনিত ধাতু তাইতো চোখ দিয়ে জল বের হয়। আমি ভাণ করে মাঝে মাঝে একটু হরি বলি। কান্নাকাটি যা কিছু দেখ ও কিছুনা। হরিচাঁদ গুরুচাঁদের নাম শুনেছ। তাঁরা আমাদের নমঃশূদ্র কুলে ওড়াকান্দীতে অবতার হয়ে এসেছেন। যা কিছু দেখনা কেন সবই তাঁর গুণে। আমার বলতে কিছুই নেই। এই বলে তারক কাঁদলেন। তাঁর কথা শুনে দেবীচাঁদ মনে মনে তার চরণ বন্দনা করলেন এবং ওড়াকান্দী যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। শুনে তারক বললেন- এতো খুবই শুভ সমাচার। ঠিক হল বারুণীর সময় তাঁকে নিয়ে শ্রীধাম ওড়াকান্দী যাবেন। তারক বাড়ি ফিরে গেলেন।
এদিকে তারকের সংগে কথা বলার পর থেকে তাঁর মনটা বেশ চঞ্চল হয়ে ওঠে। মনটা যেন আর বাঁধা মানছেনা। মনে সব সময় ইচ্ছা করে ওড়াকান্দী যাবেন। উদাস হয়ে থাকেন সব সময়। ক্রমে বসন্তকাল এল। তারকের কথা ভেবে মনটা তার ব্যাকুল হয়ে উঠলো। হঠাৎ একদিন কবিরসরাজ তারক চন্দ্র নৌকাযোগে ওখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। দেবী চাঁদের সংগে তাঁর দেখা হয়। তারককে দেখে তাঁর মন আনন্দিত হল। আপনাকে ভুলে 'বল হরিবল' বলে উঠলেন তিনি। তাই শুনে তারক প্রফুল্লিত হয়ে নৌকা ব্লাটে ভিড়ালেন। দেবীচাঁদ তাঁকে প্রণাম করলে তারক চন্দ্র তাঁকে ধরে কোল দিলেন। দু'জনেই কালাকুলি করে প্রেমে মত্ত ও ধূলায় গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। উভয় উভয়কে ধরে কাঁদেন। দু'জনই মন ভাবে আতাহারা। এভাবে কিছুক্ষণ কাটলো। তরকচন্দ্র এবার দেবীচাঁদকে বললেন- এখন কি চাকান্দী যেতে মন চায়? দেবীচাঁদ বললেন- আমার মনে আর কোন সংশয় নেই। তারক চলে গেলেন। ক হল বারুণীর সময় গুরুচাঁদকে দেখাবেন।
বারুণী আসতে তখনও ১০/১২ দিন বাকী। দেবীচাঁদের দেহ আছে পাটগাতি কিন্তু মন চলে এজ ওড়াকান্দী। সব কাজে তিনি উদাসীন। ক্ষণে ক্ষণে গুরুচাঁদকে ভেবে কাঁদেন। দেখতে দেখতে বারুণীর দিন এসে গেল। দলে দলে মতুয়ারা ওড়াকান্দী চলছেন। তারই এক দলের সংগী হয়ে তিনি শ্রীধামে পৌঁছালেন। মুখে তাঁর 'হরিবল' ধ্বনি। অবিরল ধারায় চক্ষু দিয়ে জল ঝরছে। হটাৎ তিনি তারককে দেখতে পেয়ে তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়লেন। তারক তাঁকে ধরে কোল দেন। তিনি বললেন- এবার চল তোমাকে গুরুচাঁদকে দেখাব। দেখি সেই বাঙ্গা পদে ঠাঁই দেয় কি না।
ঠাকুর গদিঘরে বসে ভক্তদের সংগে ভাবালাপ করছেন। এমন সময় দেবীচাঁকে নিয়ে তারক উপস্থিত হলেন। গুরুচাঁদের অপরূপ রূপ মাধুরী দেখে আপনাকে ভুলে এক নিরিখে চেয়ে রইলেন। অকস্মাৎ তিনি ভূমি তলে লুটিয়ে পড়লেন। তাই দেখে ঠাকুর তারকচন্দ্রকে বললেন- কিগো গোস্বামী মশাই এ কাকে নিয়ে আসলে? দেখে শুনে মনে হচ্ছে এ যেন কোন উচ্চ বংশের লোক। জ্ঞানে গুণে কোন অংশে কম নয়। বড় লোক, বড় মন এর। এবাড়ি কাঙ্গালের নিবাস, কাঙ্গালের বাড়ি, তারা এবাড়ি ভাল চেনে। এ সব বড় লোকেরা কোন দায় ঠেকে ওড়াকান্দী আসে বলতো? এ বাড়ি যারা আসে তারা ধূলা বালি মেখে থাকে, তাতেই তাদের সুখ। যারা দুঃখী দুঃখ ছাড়া সুখ চেনে না। তারা দুঃখীর মেলা মিলাতেই এ বাড়ি আসে। যারা সুখী তারা এখানে এসে কোন সুখ পাবে না। তাই তারা কেন এখানে আসবে? এ কথা শুনে দেবীচাঁদ করজোড়ে দাঁড়ালেন। চোখে তাঁর জলধারা, কম্পিত শরীর। ঘন ঘন শ্বাস বইছে। কেঁদে বললেন- হে দয়াময়, আমি অকূল সাগরে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছি। দয়াকরে আমায় টেনে তুলুন। আপনি যাকে সুখ বলছেন সেত প্রকৃত সুখ না। ধন, জন, সম্মান, প্রতিষ্ঠা এসব নশ্বর। আমি আলেয়ার পেছনে ঘুরে ঘুরে পথ হারা হয়েছি।
ওহোরে দুঃখের বন্ধু যদি দিলে দেখা।
সুখের বসতি ভেঙ্গে কর মোরে একা।। দুঃখের আকাশ তলে আমি বান্ধি ঘর।
দুঃখ হোক সখা, সাথী দুঃখ সহচর।। শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ চরিত পৃ:২৬৯/২
দুঃখের বান্ধব হরিকে যদি পাই তাহলে আমি সবই পাব। এই বলে তিনি আবার ধূলায় লোটালেন। বিভিন্ন কথার পর ঠাকুর ভক্তদের উদ্দেশ্যে বললেন- এই যে দেবীচরণ মন্ডল, বাড়ি-ঘর, ধন-সম্পদ সবই আছে। সে কোন দায় ঠেকে এবাড়ি (ওড়াকান্দী) আসবে বল? কেন ধূলায় পড়ে কাঁদছে। অবশ্য প্রভুর কী ইচ্ছা আছে জানিনা। তাই ওকে এখানে এনেছে। সেই ইচ্ছায় যদি সে তাল দিতে পারে তবে সে চিরদিন ধন্য হয়ে থাকবে। দেবীচাঁদকে বললেন- শোন দেবীচাঁদ, এছেসিসতো জন্মের মত আয়। ওড়াকান্দী এলে তার জন্ম মৃত্যু নেই। শুধু আসলে হবে না; খাঁটিভাবে, মন প্রাণ দিয়ে আসতে হবে। তাই বলছি তুই একেবারে আয়। তোর নাম বিশ্ববাসী ঘরে ঘরে বলবে। শুনে দেবীচাঁদ বলেন, হে দয়াময়, তোমার দয়ার তুলনা নেই। যখন কৃপাকরে পদ ছায়া দিয়েছো, আমার মত পাতকীর দ্বারা যদি কিছু হয় তবে কর। ঠাকুর শুনে খুশী হয়ে বললেন, এখন থেকে তাই ঘরে ঘরে হরিনাম প্রচার কর। এক জায়গায় নয়, বিভিন্ন জায়গায়। হরিনামে ডঙ্কা মেরে ঘুরে বেড়া। আমি তোর সাথে আছি, কোন ভয় নেই। হাত নাচিয়ে ঠাকুর যখন এসব কথা বলছিলেন মুহূর্তে দেবীচাঁদের প্রাণে শক্তি হল। তিনি হলেন অধ্যাত্ম শক্তি সম্পন্ন।নব বলে বলীয়ান হয়ে তিনি হরিবলে মহানন্দে নাচতে লাগলেন। এর পর গ্রামে ফিরে তিনি হরিনাম প্রচারে ব্রতী হলেন।
মতুয়া ধর্ম বিস্তার বর্ষাবিমার কর্তৃক শক্তি পেয়ে দেবীচাঁদ হলেন প্রেমোন্মাদ। মুখে হরিবল আর অন্তরে অরুতাদ। যাকে দেখেন তাকে বলেন, তোরা সব বসে বসে কী করিস? শীঘ্র ছুটে আয়। বাঞ্ছাপূর্ণকারী হরি এসেছেন ছেড়াকার। বামন রতন ফেলে কেন তোরা গৃহকোনে বসে থাকিস? তাঁর ভাব দেখে লোকে বলাবলি করে,এ মানুষ এখন পাগল হয়ে গেছে। ধন, মান, চাকরী সব ছেড়ে এখন দেখ বেহাল বেশ ধরেছে। ওড়াকান্দী গেলে সবাইকে এই রোগে ধরে। এসব কানাকানি চলতে থাকে। কেউ ভাল বলে আবার কেউ মন্দ বলেনে। সবে তিনি কান দেন না। নিজের ভাবে মেতে থাকেন। বিধির নিবদ্ধ কেউ খভাতে পারে না। হঠাৎ এলাকায় মহামারী দেখা দেয়। তাতে বহু নর নারী মরতে থাকে। ঘরে ঘরে বাড়াতে পারে না। হঠাৎ এলকোন্য মানেও কোন কাজ হয় না। এতে দেবীচাঁদ মোটেই চিন্তিত না। দিবানিশি ডঙ্কা, শিঙ্গা, ঝাঁঝ, করতাল, নিয়ে হরিনাম করেন। তাঁর ঘরে কোন রোগ বালাই নেই। অনেকে উপায় না দেখে এসে দেবীচাদের পায়ে পড়ে। তারা বলে, ভুল করে এতদিন তোমাকে চিনতে পারিনি। দয়াকরে এ বিপদে রক্ষা কর। সকলের আকুতি ও কান্না দেখে দেবীচাঁদ কিছুক্ষণ মাথা নোয়ায়ে থাকেন তার পর বলেন- দেখ আমি কিছুই জানিনা। বাবা গুরুচাঁদ সব। এটুকু জানি হরিনামে সব হয়। যদি এ বিপদে রক্ষা পেতে চাও ঠাকুরের নামে মান্য দিয়ে ঘরে ঘরে হরিনাম করগে। তাতে রোগ দূরে যাবে। আর অনায়াসে ভবপারে যেতে পারবে। তারা দেবীচাঁদকে বাড়ি নিয়ে সারারাত হরিনাম করে। সকাল বেলা দেখা গেল রোগে আরাম হয়েছে। তিনি তাদের বলেন, এভাবে প্রতি ঘরে ঘরে হরি নাম কর আর প্রাণ ভরে গুরুচাঁদকে ডাক। সে বিনে বন্ধু নেই। আমি ছাই তিনি অগ্নি।
এরপর ঘরে ঘরে এই সংবাদ পরিব্যাপ্ত হল। দেবীচাঁদের কাছে দলে দলে লোক আসতে লাগল। একে একে সবাই মতুয়া হতে লাগল। বানিয়ারী, সামর্থগাতি, কেনুয়াভাঙ্গা, টুঙ্গীপাড়া, রাজনগর সহ অন্যান্য বহু স্থানের লোক তাঁকে গুরু হিসেবে বরণ করে মতুয়া হল। এখন সকাল সন্ধ্যায় সব জায়গায় হরিনাম হতে লাগল। রোগ বালাইও দূরে গেল। এভাবে নাম প্রচার হতে লাগল। তিনি ভাল জহুরী তাই একে একে ভাল ভাল রত্ন কুড়িয়ে আনতে লাগলেন। এসব রত্নের মধ্যে বিপিন গোস্বামী ও গোপাল সাধু অন্যতম।
কেনুয়াভাঙ্গায় বিপিন চাঁদ সম্পর্কে দেবীচাঁদের ভাগ্নে। যৌবনে তিনি যাত্রাগান করে বেড়াতেন।
একদিন দেবীচাঁদ তাঁকে ডেকে বলেন-ওরে বিপিন, ভবের খেলা কতইতো খেললি। কি পেয়েছিস
এতদিন। দিন গেলে শেষে কি করবি? একথা শুনে বিপিনের জ্ঞান ফিরে এলো। এসে দেবীচাঁদের পায়ে
পড়লেন। লৌকিক সম্বন্ধ ছেড়ে গুরু রূপে বরণ করে নিলেন। দেবীচাঁদের কথামত সারাজীবন তিনি হরি নাম বিলালেন। টুঙ্গীপাড়ায় তপস্বীরাম অতি গুণবাণ ব্যক্তি। দেবীচাঁদকে গুরু মেনে গুরুচাঁদের পায়ে আত্ম নিবেদন করলেন। রাজনগরের নেপাল বিশ্বাস ও গণেশ বিশ্বাস দু'জনই দেবীচাঁদের শিষ্য। দেবীচাঁদ মাঝে মধ্যে গুরুচাঁদের কাছে যেতেন। এদিকে ঠাকুর তাঁকে বললেন- শোন দেবী, তোমাকে একটা কথা বলি। দক্ষিণে বাদাবনাঞ্চলে যাও। আমার মন বলছে সেখানে বহু ভক্ত আছে।
সেখানে গিয়ে হরিনাম প্রচার করগে। তিনি বাড়ি এসে তাঁরই এক শিষ্য রাজনগর নিবাসী গণেশকে পাঠালেন দক্ষিণ দেশে। তার আজা পেয়ে গণেশ বর্তমান বাগেরহাট জেলার সুন্দরবনাঞ্চলে গেলেন। তিনি প্রথমে আসেন ডেউয়াতলা গ্রামে। একবাড়িতে রাতে অবস্থান করে হরিনাম করেন। সেখানে আরো কিছু মতুয়া ছিলেন। মতুয়ারা গান গায় আর দু'চোখে অশ্রুধারা বয়ে যায়। সেই রাতে সেখানে মন্ত্রীখালীর গোপাল হাওলাদার ও বেতকাটার গণেশ আসেন। দু'জনের মামা ভাগ্নে সম্পর্ক। গান শুনে গোপালের চোখেও জলধারা বয়। পুরাতন কথা তাঁর মনে পড়ে যায়। বিবাহের দিন তিনি এমনি সুধামাখা গান শুনেছিলেন। ভস্মে কোন দিন আগুন চাপা থাকে না। আজ মনের মধ্যে সুপ্ত সেই আগুন জ্বলে উঠলো। এই গান শুনে। গোপাল কাঁদলেন। তিনি গণেশকে তাঁর বাড়ি যাবার আহবান জানালেন। তিনি বলেন- এ গান আপনি কার কাছে পেয়েছেন? যাঁর গান সে কোথায়? আমার মন চাইছে সেই মানুষের দেশে যেতে। তিনি আরো বলেন- এই যে আমার মামা গণেশ আর আপনার নামও গণেশ। আপনারা দু'জন মিত্র হন এটাই আমার দাবী। আপনি গেলে খুবই আনন্দ পাব। গোপালের কথায় গাণেশ তাঁর বাড়িতে গেলেন। তাঁর কাছ থেকে ওড়াকান্দী, গুরুচাঁদ ঠাকুর ও দেবীচাঁদের কথা শুনলেন। লক্ষ্মীখালী গিয়ে তিনি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে গেলেন।
গনেশের কাছে সব শুনে গোপাল বানিয়ারী যেতে মনস্থ করলেন। বেতকাটার মাধব ছিলেন তাঁর মামাত ভাই। তাকে সব কিছু জানালেন। তাঁর সংগে মিশলেন শ্রীনাথ। তিনজনে মিলে একদিন তাঁরা বানিয়ারী গিয়ে দেবী চাঁদের বাড়িতে উপস্থিত হলেন। সেখানে দেবীচাঁদের সাথে সাক্ষাৎ হয়। এরপর তিনি লক্ষ্মীখালী ও বেতকাটা গ্রামে যান। এভাবে বাদাঞ্চলে তিনি হরি নাম প্রচার করেন। গোপাল সাধু তাঁর আহরিত মনিকাঞ্চন। গোপালের ভক্তিগুণে তিনি খুশী এবং তাঁর মত ভক্ত পেয়ে দেবীচাঁদও ধন্য।
বেশ কয়েকবার লক্ষ্মীখালীতে গিয়ে দেবীচাঁদ বুঝে গেছেন গোপাল মহাশক্তিধারী মানুষ। তাঁর গুণে একদিন বহুলোক হরিনামে মাতবে। তাঁর নাম হবে মহা উদ্ধারণ। তিনি কীভাবে গোপালকে গুরুচাঁদের কাছে নিয়ে যান, কীভাবে গুরুচাঁদের কৃপাভাজন হলেন সেসব গোপলের জীবন বৃত্তান্তে লেখা হবে। এখন দেবীচাঁদ কী কী কাজ করেছেন সে সম্পর্কে আলোকপাত করতে চাই।
জাতির কল্যাণে গুরুচাঁদ যখন বিধবার বিয়ে দেবার আজ্ঞা দেন তখন আনেক ভক্ত পিছিয়ে গেলেও একনিষ্ঠ ভক্ত দেবীচাঁদ এগিয়ে আসেন। ঠাকুরকে তিনি আশ্বস্থ করেছিলেন- বাবা, মঙ্গল অমঙ্গল আমি বুঝিনা। আপনি যাতে সুখী হন তার জন্য যা করতে বলবেন আমি তাই করবো। বিধাব বিবাহ তুচ্ছ কথা এর চেয়ে কঠিন কিছু যদি হয় দেহে যতক্ষণ প্রাণ আছে তা নিশ্চই করে যাব। এর পর নিজ বাসে এসে নিজের ভক্তদের কাছে ডেকে জনে জনে বিধবাদের বিবাহ দিতে বলে দিলেন। জানা যায় দেবীচাঁদ তাঁর শিষ্য বাদে নিজেই সাতাশ জন বিধবার বিয়ে দেন। গোপাল, বিপিন, এই ভক্তও এ কাজে যথেষ্ঠ পারদর্শীতার পরিচয় দেন। ফলে ঠাকুর গুরুচাঁদ দেবী চাঁদের উপর দারুণ খুশী হন। বিধবাদের বিয়ে দেয়ায় তাঁর অসামান্য প্রচেষ্টার কথা ঠাকুর মীডকে জানালে মীড দেবীচাঁদের ছবি তুলে রাজ দরবারে পাঠান। দেবীচাঁদের শিষ্যদের মধ্যে গোপাল সাধুই অন্যতম প্রধান শিষ্য রূপে স্থান দাখল করে নেন। গোপাল সাধুই হলেন গুরুচাঁদকে দেয়া দেবী চাঁদের গুরুদক্ষিণা।
বিধবার বিয়ে দেয়া হলে 'চন্ডাল' গালি মোচন হয়। এখবর শুনে দেবীচাঁদ খুব খুশী হন। দৌ চাঁদের কীর্তির কথা চারিদিকে রটে যায়। শুনে সবাই ধন্য ধন্য করেন। দৈবক্রমে তাঁর কালাজ্বর হয়। জ্বরে আক্রান্ত হলে দেবী চাঁদ সবাইকে কাছে ডেকে বলেন- আমার সময় হয়ে গেছে, এখন যে দেশে যেতে হবে। সবাই পবিত্র চরিত্রে থেকো। সব সময় ওড়াকান্দী যাতায়াত করো। গুরুচাঁদ কিন্তু সামান্য মানুষ না। ঠাকুর যা বলে প্রাণ পণে সে সব কাজ করো। সেই পদে আত্ম সমর্পণ করো। এরপর তিনি সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে নিজ দেশে চলে যান।
প্রসঙ্গক্রমে বলা আবশ্যক, হরিচাঁদ যুগে যে সব ভক্তরা এসেছিলেন তাঁরা শুধু প্রেম-ভক্তি নিয়েই চলে গেলেন। ভক্তদের অশ্রুবারি সাধারণ মানুষের দেহজমি সরস হয়ে চাষের উপযুক্ত হয়েছে। ভক্তিরসে ক্ষেত্র যাঁরা সিক্ত করেছিলেন তাঁদের কাজ ঐ খানেই শেষ। গুরুচাঁদ যুগে যে সব ভক্তরা এসছিলেন তাঁরা ছিলেন কৃষি কাজে নিপুণ। ত্রিবেণী সঙ্গমে যেমন তিনটি ধারা এসে মিলিত হয় তেমনি তিন জন ভক্তের মিলিত ধারা এসে ওড়াকান্দী মিলিত হয়। তাঁরা হলেন তারক চন্দ্র, মহানন্দ ও দেবী চাঁদ। এই তিন শক্তি গুরুচাঁদের পূজা করেছিলেন। তাঁদের শক্তি যাঁরা যাঁরা পেয়েছিলেন তাঁরাই বিশ্ববাসীকে মাতিয়ে তুলেছিলেন। উক্ত তিন শক্তি অর্ঘ্যছলে কতিপয় ভক্তকে গুরুচাঁদেরু পাদপদ্মে সমর্পণ করেছিলেন। তারকচন্দ্রের অর্ঘ্য হল- যাদব, নকুল, হরিবর, মনোহর ও রমনী। এই সব ভক্তদের তিনি গুরুচাঁদের পাদ পরে অঞ্চলী দিয়েছিলেন। মহানন্দ দিয়েছিলেন অশ্বিনী গোঁসাইকে। তারকচন্দ্রও তাঁকে আশীর্বাদ করেছিলেন। দেবীচাঁদের অর্ঘ্য হল- গোপাল, বিপিন, নেপাল, মাধব ও তপস্বীরাম। ত্রিশক্তির অর্ঘ্য মধ্যে যাঁরা ছিলেন তাঁরাই মতুয়াদের স্তম্ভ বলে স্বীকৃত। এসব ভক্তরা গুরুচাঁদের প্রতি এতই ভক্তি ও শ্রদ্ধা ছিল যে ঠাকুর যেটা বলতেন সেটাই ঠিক যেন বেদ বাক্যের মত।
তুমি যাহা আজ্ঞা কর মোরা তাই করি।
জাতি মান সব তুমি বাঞ্ছা পূর্ণকারী।। শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ২৮৩/১
দেবীচাঁদ কত তারিখে (সম্ভবতঃ ১৩২০ বঙ্গাব্দ ১৯০৫ খ্রিঃ) দেহ ত্যাগ করেন সেই তথ্য পাওয়া দুষ্কর। আমাদের পূর্বাপর লেখকগণ এবিষয় কোন কিছু লেখেননি। ফলে এ বিষয়টি পাঠকদের অজানা থেকে গেল। দেবীচাঁদকে নিয়ে কোন জীবনী গ্রন্থ থাকলেও এখনো আমার অজানা। কোন সহৃদয় ব্যক্তির জানা থাকলে আমাকে পাঠালে কৃতজ্ঞ থাকবো।
শ্রীমৎ গোপালচাঁদ সাধুঠাকুরের জীবন কথা
গোপাল সাধুর নামটি শোনা মাত্র ভক্তমহলে এক অপরিসীম শ্রদ্ধাবোধ জাগরিত হয়। তিনি অসামান্য অধ্যাত্মশক্তির অধিকারী ছিলেন। তাঁর ভক্তি গুণে ঠাকুর গুরুচাঁদ তাকে কৃপা করেছিলেন। গোপাল সাধুজীর নাম শোনেনি এমন ভক্ত পাওয়া যায় না।
বর্তমান বাগেরহাট জেলার মোড়েলগঞ্জ থানাধীন লক্ষ্মীখালী গ্রামে যারশত আশি সালের চব্বিশে বৈশাখ সোমবার (১১ মে, ১৮৪৭) গোপাল সাধু জন্য গ্রহণ করেন। তাঁর পুরানাম গোপাল চন্দ্র হাওলাদার। ভক্তমহলে তিনি গোপাল সাধু নামেই পরিচিত। তাঁর পিতার নাম রামচরণ হাওলাদার এবং মাতার নাম কালীতারা দেবী। সাধুজীর পিতা এলাকার মধ্যে ধনবান লোক ছিলেন। রামচরণের আর এক ভাই ছিলেন তাঁর নাম জয়ধর হওলাদার। তাঁদের আদি নিবাস ছিল বেতকাটা গ্রামে। সেই গ্রামেই তাঁর বিয়ে হয়। বিবাহের পূর্বে রামচরণ লক্ষ্মীখালীতে দশানীর জমিদারদের কাছ থেকে বহু সম্পত্তি পেয়ে সেখানেই বসবাস করেন। তিনি ছিলেন সত্যবাদী ও জিতেন্দ্রিয়। মিথ্যাকথা, জুয়াচুরি এসব তিনি জানতেন না। কালীতারা দেবীও সতী স্বাধ্বী পতিব্রতা রমণী ছিলেন। তাঁদের কোল জুড়ে আসেন গোপাল সাধু।
বাল্যকালে গোপাল সামান্য বিদ্যাশিক্ষা করেন। সাংসারিক কাজকর্ম মাঝে মধ্যে করতেন। এভাবে বয়স যখন ১৬ বছর তখন পিতা তাঁকে বিবাহ দেন। আড়ংঘাটা গ্রামে গোবিন্দ হাওলাদারের কন্যার সাথে তাঁর বিয়ে হয়। স্ত্রীর নাম কাঞ্চন দেবী। রূপে গুণে তিনি অতুলনীয়া। বিয়ের সময় একটি ঘটনা ঘটে। রাতে বিবাহান্তে সকাল বেলায় গোপাল পাখানায় গেছেন এমন সময় তাঁর শালিকা কামিনী গান ধরেন। তিনি ওড়াকান্দীর ভক্ত। মন প্রাণ খুলে তিনি গান গাচ্ছিলেন। শুনে গোপালের প্রাণ ছুটে যায় অজানা দেশে। কে যেন তাঁকে ডাকছে। গানের কলিটি ছিল-
কবে যাব ওড়াকান্দী
ও ঘরে রয়না আমার মন।
দরদ ভরা কন্ঠে প্রাণ উজাড় করে কামিণী গান গাইছিলেন আর গোপালের দু'চোখে অশ্রুধারা বয়ে যাচ্ছিল। বিরহ ব্যথায় সেই মন মানুষের কথা ভাবছেন, কোথায় তিনি। কোথায় তাঁর প্রাণের বান্ধব? কোথায় গেলে পাব তাঁকে? কামিণীর গানে আত্মভোলা হয়ে কাঞ্চন দেবীও গাইলেন। সুরের আবেশ যেন আকাশ বাতাসে মিশে যাচ্ছিল। গোপাল পায়খানায় বসে শুনছেন। কিছুক্ষণ পর গান বন্ধ হল। গোপাল ফিরে এলেন। দু'চোখে তার অশ্রু। কামিণীর কাছে গিয়ে জানতে চাইলেন- দিদি ওড়াকান্দী কে আছে? কার গান কর? কে তোমাকে এ গান শেখাল? তার বাড়ি কোথায়? এগান শুনে কেন প্রাণ কোঁদে ওঠে? বল, কোথায় গেলে আমি তাঁর দেখা পাব? গোপালের কথা শুনে কামিনী বললেন- শোন ভাই, ওড়াকান্দী এক সোনার মানুষ এসেছিল। নাম তাঁর হরিচাঁদ। তাঁর ভাবে মত্ত যারা তাদের মতুয়া বলে। তারাই এই গান করে। আমি তাঁদের কাছ থেকে গান শিখেছি। এরকম বহু গান আছে।
বিবাহান্তে গোপাল ঘরে ফিরে এলেন কিন্তু কামিণীর গানের কথা তিনি ভুলতে পারলেন না। মনে মনে ভাবলেন কবে ওড়াকান্দী যাব। মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক। কালক্রমে গোপালের আর যাওয়া হলনা। সংসার এসে তাঁকে ঘিরে ধরল। ক্রমে তাঁর দুই পুত্র তিন কন্যার জন্ম হল। ছেলের নাম হরষিত ও কাশিনাথ এবং মেয়ের নাম সহচরী, মানিক্য ও সাবিত্রী। জ্যেষ্ঠ পুত্র গোপালের জন্মের পর রামচরণ মারা যান। গোপালের খুড়া জয়ধর হাওলাদার নিঃসন্তান ছিলেন। তাই তিনি গোপালের সংগে থাকেন। মেঘের আড়ালে যেমন সূর্য ঢাকা থাকে তেমনি সংসারের ঘোর মায়াজালে ওড়াকান্দীর কথা গোপাল ভুলে গেলেন।
এদিকে দয়াময় গুরুচাঁদ সুধা নেবার জন্য যখন সবাইকে ডাকছেন তখন দলে দলে নর নাই ওড়াকান্দীর পানে ছুটে যাচ্ছেন কিন্তু বাদাবনের মানুষ তাতে সাড়া দিচ্ছে না। যখন কেউ গেল না তখন গুরুচাঁদ নিজেই সেখানে লোক পাঠালেন ভক্ত খুঁজে আনতে। প্রথমে দেবীচাঁদকে বলেন। তিনি প্রথমে তাঁর শিষ্য গনেশকে পাঠান অগ্রদূত হিসেবে। এসব পূর্বেই লেখা হয়েছে। দেবী চাঁদকে ধরে গোপাল মতুয়া হন। তাঁর সংগে মাতেন শ্রীনাথ ও মাধবেন্দ্র। বাদাঞ্চলে তাঁরাই প্রথম মতুয়া। পরে গোপাল সাধুজীকে ধরে এই ধারা বিস্তৃত হয়। এরপর দেবীচাঁদ গোপালকে নিয়ে ওড়াকান্দী যান। তাঁকে দেখে গুরুচাঁদ মহাখুশী। এজন্যই তিনি এতদিন অপেক্ষায় ছিলেন। যাওয়া মাত্র তিনি গোপালকে দেখে দেবীচাঁদকে বললেন- ও দেবী, এ কাকে এনেছ? এ দেখি আমার নন্দের গোপাল। গোপাল ঠাকরকে তাঁর ভাবে মুগ্ধ হয়ে ঠাকুর তাঁকে কৃপা করলেন। থেকে তিনি গোপাল সাধু নামে পরিচিত হলেন। যেন পুনর্জন্ম হল।
গুরু কৃপাতীর্থ জলে গোপাল ডুবিল।
নর দেহে তাই তাঁর পুনর্জন্ম হল।। শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ চরিত পৃ:৩২২/১
গোপালের প্রতি পাষন্ডদের ক্ষোভ ও নায়েবের অত্যাচার
গোপাল হরিনামে মাতলেন। তাঁর আশ্রয়ে বহুলোক মতুয়া হন। সকাল সন্ধ্যা তিনি হরিনামে বিভোর থাকেন। গোপালের ভাব দেখে স্থানীয় পাষন্ডের দল ক্ষেপে গেল। তাঁকে কিভাবে জব্দ করা যায় সেই সুযোগ খুঁজতে লাগল। একদিন একটা সুবর্ণ সুযোগ এসে গেল। সেই দিন দেবীচাঁদ গোপালের বাড়ি এসেছিলেন। পাষন্ডের দল নায়েবের কাছে গিয়ে নালিশ জানাল- গোপালের ঘরে তার গুরু এসেছে। শীঘ্র তাঁকে কাছারীতে ডেকে এনে অপমান ও জরিমানা করুন যাতে আর হরি নাম না করে। পাষন্ডেরা নায়েবকে। এ কাজের জন্য দশ টাকা নজরানা দিল। অর্থলোভে নায়েব পেয়াদা পাঠাল গোপাল ও তাঁর গুরুদেবকে কাছারীতে ধরে আনার জন্য। কিন্তু গোপালের অনাগ্রহে দেবীচাঁদ কাছারীতে না গিয়ে শুধু গোপালই গেলেন। এদিকে পাষন্ডের দল ষড়যন্ত্র করল কী ভাবে নায়েবের শাস্তি ছাড়াও তাঁকে জব্দ করা যায়। কারণ তাদের ধারণা, নায়েব তাঁকে বড় জোর জুতা পেটা বা জরিমানা করতে পারে। এর বেশি কিছু হবেনা। তাই গোপালকে মারবে বলে স্থির করল। সেই উদ্দেশ্যে তারা পথিমধ্যে খালপাড়ে ঝোপের আড়ালে লাঠি সোটা নিয়ে লুকিয়ে থাকল সময় মত আক্রমন করবে বলে। বিকালের দিকে গোপাল কাছারী গেলেন। ফিরতে তাঁর সন্ধ্যা হয়ে যাবে তাই তারা সন্ধ্যার আগেই খালের দুই পারে অবস্থান নিল।
গোপাল কাছারী গেলে নায়েব ক্রেধে ফেটে পড়ল। তাঁকে মাটিতে বসতে দিল। তিনি কেন হুকুম অমান্য করে একা এলেন, গুরুদেবকে কেন সংগে আনলেন না, সেজন্য নায়েব খুবই ক্রদ্ধ হলো। গোপাল বললেন- যদি দোষ হয়ে থাকে সেটা আমার, আমার গুরুদেব কেন আসবেন? তাঁর তো কোন দোষ নেই। আমাকে নিয়ে যা করার করুন। আমার দোষের শাস্তি কেন তাঁকে দেবেন? একথায় নায়েব আরো ক্ষেপে গেল। রাগে তার বুদ্ধি লোপ পেলো। গোপালকে বহু কটুকথা বলে তিনশত টাকা জরিমানা করল কিন্তু অন্য কোন শাস্তি দেয়নি। আরো বলে দিল এক সপ্তাহের মধ্যে জরিমানার টাকা চাই। খেলাপী হলে গুরুতর শাস্তি হবে।
গোপাল ভেবেছিলেন আজ যেন পরিণামে কী হয়। সেটা না হওয়ায় তিনি মনে মনে হাসলেন। ভাবলেন- হে ঠাকুর, তুমি কত দয়াল। তোমার দয়ার তুলনা নেই। নায়েবকে বললেন- এবার তবে যাই। জরিমানা করেছেন সেটা শুনলাম। আমি সামান্য মানুষ। মালেকের প্রজা হিসেবে চিরদিন আছি। ভাবছি এবার মালেকের কাছে যাব। দেখি তাঁর হাতে পায়ে ধরে জারিমানার টাকা মাফ হয় কিনা। কোন দোষে এড টাকা জারিমানা করলেন একটু বলবেন কি? নায়েব বলল- তোমার বহুতর দোষ। দেশের মধ্যে হরি নাম কর, তার উপর দেব দেবী মাননা। এসবের জন্য তোমার জরিমানা হয়েছে। গোপাল হেসে বললেন- খুব ভাল বলেছেন নায়েব মশাই। শুনলামও ভাল। তা হলে তো দেশ থেকে হরিনাম উঠে গেল। যা হয় হোক যত জরিমানা মারপিঠ হোক তবু হরিনাম করা ছাড়বো না। দেখি জমিদার বাবু কী বলেন। এই বলে তিনি বাড়ির দিকে রওনা লেন।
এদিকে সন্ধ্যার আঁধারে ঘিরে গেছে কিন্তু গোপাল আসছে না। দেবীচাঁদ বিপদের আশংকা করে গোপালের ছেলে, মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে হরিনাম করতে লাগলেন। বিপদের বান্ধব হরি। সে বিনে কে রক্ষা করবে? তাই সাবাই আকুল পরানে হরিনাম করতে লাগলেন। গোপালের সন্তান ও স্ত্রী সবাই কেঁদে আকুল। অন্য যারা হরিনাম করছিল তারাও আকুল। তাঁদের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। তাঁদের সাথে বনের পশুরাও যেন কাঁদতে লাগল। ভক্তের কান্নায় শ্রীহরির আসন টলে উঠলো। ভক্তকে রক্ষার জন্য ঠাকুর নিজেই এলেন। গোপাল একাকী অন্ধকারে পথ চলছেন। খালকূলে পাষন্ডেরা আবস্থান করেছে। এবার নারাকারে শ্রীহরি পাষন্ডের কাছে গেলেন। প্রথমে উত্তরপারে গিয়ে বললেন- তোমাদের দেখি বুদ্ধি শুদ্ধি নেই। কোন ভাবে কাজ কর বুঝে পাইনা। পাষন্ডেরা দেখল তাদের সাথী একজন। তাতে তারা আশ্বস্থ হল। বলল- তুমি কী বলতে এসেছ বল। শ্রীহরি বললেন- কোন কিছু শুনতে পার না? অন্ধকারে চোখ কান কী বন্ধ হয়ে গেল নাকি? খালের দক্ষিণ পারে চল, দুইপারে থাকা ভালনা। বরং এক পারে গিয়ে সবাই এক সংগে কাজ করা ভাল। শুনে দক্ষিন পারের লোকেরা বলল-আমাদের এই পার দিয়ে গোপাল আসবে। আমরা কাজ করবো আর তোরা নাম নিবি সেটা হবে না। এসব চালাকী চলবে না। চল এক জায়গায় যাই। এক সাথেই কাজ করবো। এক যোগে কাজ করলে কাজ ভাল হয়। পাষন্ডেরা বলল তবে তাই চল। তখন উত্তর পারের দল দক্ষিণপারে গেল। অমনি শ্রীহরি অদৃশ্য হলেন। এ দেখে দক্ষিণ পারের দল বলল- একি কান্ড, স্থান ছেড়ে এখানে এলে কেন? উত্তর পারের দল বলল- সে কি কথা? ডেকে এনে আমাদের অপমান করছ কেন? মাথা ভেঙ্গে দেব বুঝলে? তোমাদের একজনইতো আমাদের ডেকে নিয়ে এলো। দক্ষিণ পারের দল রেগে বলল- মিথ্যাকথা।আমাদের স্থানছেড়ে কেউ তোমাদের ওপার যায়নি। তোরা মিথ্যাবাদী। এভাবে কথা কাটাকাটি চলছে। হরি যাকে রক্ষা করে কে তাকে মারতে পারে? পাষন্ডের দল গন্ডগোলে মত্ত। অন্যদিকে কারো খেয়াল নেই। গোপাল হরি চিন্তা করতে করতে নিরাপদে বাড়ি আসলেন। গোপালকে সুস্থ শরীরে ফিরে পেয়ে সবাই প্রেমে মগ্ন হয়ে হরি বলে কাঁদতে লাগলেন। এভাবে নিশিভোর হল। সকাল বেলা দেবীচাঁদ বানিয়ারী চলে গেলেন। ঠাকুরের কৃপায় গোপাল এবার পাষন্ডদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেলেন।
গোপালের কৃপাসিদ্ধি:
বাগেরহাট শহরের অদূরে দশানী গ্রাম। সেই গ্রামে বসবাস করেন যদুনাথ বিশ্বাস। তাঁর অন্য দুই ভাই হলেন-চন্দ্রনাথ বিশ্বাস ও শ্রীনাথ বিশ্বাস। তাঁরা এই অঞ্চলের বিখ্যাত জমিদার। তাঁরা পরম দুইড়াও সৎ প্রকৃতির লোক। গোপাল সাধুজী তাঁদের প্রজা। গোপালকে তাঁরা চিরদিন ভালবাশেরম প্রজা হিসেবে গোপাল মাঝে মধ্যে জমিদার বাড়ি যেতেন। তিনি হরিনামে মেতেছেন জেনে জমিদারও খুশী। শ্রীনাথ বাবুর ছেলে মহেন্দ্র নাথ। তিনি পরে গোপালকে গুরু হিসেবে বরণ করে হরি নামে মেতেছিলেন। পূর্বের ঘটনার পর গোপাল একদিন দশানী গিয়ে জমিদার বাবুর সংগে দেখা করেন। তাঁর কাছে কুশলাদি শোনার পর নায়েবের ঘটনাও শুনলেন। শুনে জমিদার বাবু খুব রেগে গেলেন এবং পরদিন এই অন্যায় কাজের জন্য নায়েবকে বরখাস্ত করলেন। চাকরী ছেড়ে নায়েব বাড়ি চলে গেল। গোপালের কিছু হলনা দেখে পাষন্ডের দল পুনরায় সুযোগ খুঁজতে লাগল কী ভাবে তাঁকে জব্দ করা যায়। তারা বুঝেছিল শত্রুতা করে গোপালকে জব্দ করা যাবে না। একদিন সুযোগও এসে গেল। লক্ষ্মীখালী থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে কিছু দূবে প্রসন্ন সুতারের বাড়ি। তাঁর স্ত্রী অলকা দৈবে কলেরায় আক্রন্ত হল। পাষন্ডেরা একত্রিত হয়ে মন্ত্রণা করল- এই তো সুযোগ। এইবার গোপালকে রোগী দেখার ছলে ডেকে আনতে হবে। অলকা মরলে রোগী মারার দায়ে প্রহার করে পুলিশে দিতে হবে। খুনী হয়ে তাঁর জেল হবে। এই মন্ত্রণা করে তারা অলকার স্বামী প্রসন্নকে গোপালের কাছে পাঠাল।
যেজন সঁপেছে প্রাণ শ্রীগুরুর পদে।
গুরু তারে রক্ষা রক্ষা করে আপদে বিপদে।। শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৩২৬/২
প্রসন্ন গোপালের কাছে এসে কেঁদে বলল- আমার স্ত্রীর কলেরা হয়েছে। এযাত্রা বাঁচে কিনা বাঁচে। দয়াকরে আমার বাড়িতে আসুন। তার ইচ্ছা হরিনামে মুতুয়া হবে। আপনি গেলে সে পরাণে বাঁচবে। প্রসন্নের কথায় সহজ সরল গোপাল স্বীকার করেন। সেই আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে প্রসন্ন বাড়ি ফিরে গেল। তার কাছে সব শুনে পাষন্ডেরা জোট হয়ে থাকল। এদিকে সাধুজী মতুয়াদের ডেকে বললেন- আজ প্রসন্নের বাড়িতে যেতে হবে। আজ মন প্রাণ দিয়ে হরিচাঁদকে ডাকা চাই। কী জানি গ্রাম্য লোকে কোন দুষ্টবুদ্ধি এটেছে কি না। একদিন তো সবাইকে মরতে হবে। আজ হরি নামের মধ্য দিয়ে না হয় মরণটা হোক। তাতে তোমাদের কীর্তি রবে। তাঁর কথায় সবাই এক বাক্যে যেতে স্বীকৃত হলেন।
তখনকার দিনে তেমন মতুয়া ছিলনা। যে কয়জন ছিল সবাই ডংকা, শিঙ্গাঁ, ঝাঁঝ, করতাল বাজিয়ে গোপালের সংগে চললেন। গোপাল সবার আগে, তাঁর পিছে মাধব, তার পর অন্য মতুয়ারা। রাত্রি একপ্রহর কালে দল বল নিয়ে গোপাল প্রসন্নের বাড়ি গেলেন। বহুলোক একত্রিত হল। বস্ত্রে ঢাকা মরা শব দেখে গোপাল ভাবলেন আজ আর এ বিপদে উদ্ধার নেই। দেখি বিপদের বান্ধব হরিচাঁদ কি করেন। নিজের প্রাণে সাহস সঞ্চার করলেন, অন্য মতুয়ারাও তাঁর কথায় প্রাণে বল ফিরে পেলেন। সেদিনের ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা করার সাধ্য আমার নেই। শুধু মাত্র সাধারণ বর্ণনাটা দিয়ে যাচ্ছি। বিপদ রাক্ষসী বদন মেলে আছে, সম্মুখে বসনে ঢাকা মৃতা নারী, চারিদিকে পাষন্ডেরা। অল্প সংখ্যক মাত্র
প্রভু বলে হে গোপাল। বসে থাক কেনে।
অলকা চাহিল চাল- চা'ল দেও এনে।। শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৫৩১/১
হুকুম শুনে গোপালের মনে এক যুক্তি এলো। হরি যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন সেখান থেকে এক মুষ্টি খুলি এনে অলকার হাতে দিয়ে বললেন- সর্বফলদাতা শ্রীহরির পদধুলি, সেই গুলি তোমার হাতে দিচ্ছি। উনানে জল গরম করে হরি বলে ওতে ছেড়ে নিও। যাঁর স্পর্শে মরা দেহে প্রাণ পায়, আজ তাঁর পদধূলিতে অন্নপাক হবে। প্রেমভয়ে অলকা সেই ধূলি নিয়ে গোপালের আজমত জলে ছেড়ে দিল। হাঁড়ির মুখ ঢেকে সে হরি বলে কাঁদতে লাগল।
এ সময় ঘটলা আর এক অদ্ভুত ঘটনা। এক জায়গায় পাষন্ডরা একত্রিত ছিল। গোপালকে মারতে যারা মন করে এসেছিল অকস্মাৎ তারা কেঁদে উঠলো। দেখতে দেখতে তাদের হাত পা ফুলে জ্বালা করতে লাগল। দারুণ ব্যথায় কাতর হয়ে তারা শ্রীহরির পায়ে গিয়ে পড়লো। তিনি বললেন- ওরে ওরে পাষন্ড দেমাকী, কোন দোষে এই হল খুলে বল দেখি। তারা বাধ্য হয়ে পূর্বাপর ঘটনা খুলে বলল। শ্রীহরি বললেন- যা গোপালের কাছে। গোপাল যা বলে তাতেই মুক্তিপাবি। গোপাল তখন তাদের বললেন, হরিভক্তরা যেখানে কীর্তন করে সেখানেই দয়াল হরিচাঁদ আসেন। কীর্তনের ধূলি হল মহাশক্তি এটা মাখলে সর্বব্যাধি দূর হয়। ভক্তি করে সবাই সেই ধূলি অঙ্গে মাখগে। রোগ পীড়া সব দূর হয়ে যাবে। তখনি পাষন্ডেরা ধুলায় লুটাল এবং পলকের মধ্যে তাদের রোগ দূর হয়ে গেল।
এ সময় এক ব্যক্তি ধূলায় পড়ে কাঁদতে থাকে। এক সপ্তাহ আগে তার পুত্র মারা যায়। কিন্তু তার ছেলের দেহাংশ অবশিষ্ট না থাকায় তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। এরপর অলকা প্রসাদান্ন রান্না হয়েছে বলে জানান। তাতে উপস্থিত সবাই বিস্মিত হয়। কারণ ইতিপূর্বে বিনা চাউলে অন্ন পাক হওয়া এবং মৃত দেহে প্রাণ ফিরে পাওয়ার ঘটনা কখনো শোনা যায় নি। এটা একটা অশ্রুতপূর্ব ঘটনা। এতে সবার চোখে প্রেমের বন্যা বয়ে গেল। ভক্তাভক্ত, পাষন্ড, সাধারণ মানুষ কেউ বাকী থাকল না। সবাই ভূমিতলে পড়ে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। কী যে হল, কে এল কী যে বলে গেল কিছুই বোঝা গেল না। সবই যেন স্বপ্নবৎ। এর পর সবাই সেই প্রসাদান্ন খেলেন এবং সবার অলক্ষ্যে গোপালের হাত ধরে শ্রীহরি বনের মধ্যে চলে গেলেন। সবাই দেখল গোপাল যেখানে ছিলেন সেখানে নেই। বনান্তরালে বসে দু'জনের মধ্যে কী কথা হল পৃথিবীর নর নারী কিছু জানল না। অল্প কিছু সময় পর শ্রীহরি ও গোপাল ফিরে এলেন। তখনি হরি শক্তি প্রসন্নকে ছেড়ে গেল। হতজ্ঞান সে প্রসন্ন মাটিতে পড়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে এলে সে হরি বলতে লাগল।
এভাবেই গোপালের কৃপাসিদ্ধি হয়। দিনে দিনে তাঁর সেই ভাব বৃদ্ধি পায়। সেদিন তাঁকে গোপাল সাধু নামে ডেকেছিলেন বলে সেই থেকে তিনি ঐ নামে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি হন অধ্যাত্মা শক্তি সম্পন্ন, গুরু চাঁদের প্রিয় ভক্ত।
তারকচন্দ্র ও দেবীচাঁদের বর লাভ।
মৃত মানুষ বেঁচে যাওয়া, বিনা চাউলে অন্ন পাকের ঘটনা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে দেরীয়ান গোস্বামী গোপালকে জড়িয়ে ধরে বললেন। গোপালরে, তুই আমায় বাঁচালি । আমার যা কিছু আছে তোকে দিয়ে যাব। এর পর কিছু দিন অতিবাহিত হয়। বিধাব বিবাহকালে দেরী চাঁদের আজায় গোপাল বন্ধ পরিশ্রম করে বেশ কয়েক জনের বিবাহ দেন। তারপর একদিন গোপালকে সংগে দিয়ে দেবীচীগ গুড়াকান্দী যান। তিনি ঠাকুর শুরুচাঁদকে গোপালের পরিচয় দেন। সেদিন ঠাকুর বলেন- ও দেরী, এ কাকে এনেছ, এতো আমার 'নন্দের গোপাল'।
শ্রীধামে বসে কবি রসরাজ তারক চন্দ্রের সংপে গোপালের পরিচয় হয়। তিনি তাঁতে কয়েকবার লক্ষ্মীখালী যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন কিন্তু তাঁর আর যাওয়া হয়নি। পূর্বোক্ত ঘটনার দুই গছর পর গোস্বামী তারক চন্দ্র বর্তমান মোংলা উপজেলার খোনকারবেড় (বর্তমান খাসেরডাঙ্গা) গ্রামে কবি গান করতে আসেন। বানিয়াবী বসে গোপাল সংবাদ পেয়ে দ্রুত খোনকারবেড় আসেন। গানের আসরে এসে তিনি গুনতে পান তারকের কলেরা হয়েছে। তাঁর সংগী সাথীরা কেউ তাঁর ধারে যায়না। রোগ নিয়ে তিনি একা রয়েছেন। গোস্বামী রোগের যন্ত্রণায় খুব কন্ঠ পাচ্ছেন। তাই দেখে গোপালের চোখ ভরে জল এলো। তারক চন্দ্রগ্র পায়খানা করতে যাবেন বলে উঠতে যান। গোপাল এসে তাঁকে ধরতে গেলে তিনি রেগে যান। গালা-গালিও করেন। ভয়ে হাত ছেড়ে দিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন। কথা বলেন না। পুনরায় উঠতে যাবার সময় তাঁকে ধরতে গেলে তিনি আবারও রেগে যান এবং বলেন তুই কে রে? কোথায় বাড়ি? কোথা থেকে এসেছিসরে। গোপাল মনে মনে ভাবেন কী উত্তর দেবেন। তিনি ওড়াকাব্দী থেকে বানিয়ানী হয়ে এখানে এসেছেন। করজোড়ে আঁখি জলে ভেসে গোপাল বলেন-আমি গোপাল, ওড়াকাব্দী থেকে এখানে এসেছি। আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি গোপালকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, ওরে দয়াময় গুরুচাঁদ বুঝি আমাকে দেখার জন্য তোকে পাঠাল। তোকে কাছে পেয়েছি, আর কিছু চাই না। এবার বুঝি আমি আর মরব না। এরপর তিনি প্রাণপনে গোস্বামীজীর সেবা করতে লাগলেন। নিজ হাতে মল মূত্রাদি পরিস্কার করে দিলেন। তাঁর সেব্য যত্নে তারক বিস্মিত। যাত্রার প্রাক্কালে তিনি বললেন। শোন গোপাল, তুমি যেভাবে আমার সেবা করেছ তাতে এই বর দিচ্ছি- সাধন ভজন তোমার কিছুই লাগবে না। দেবী দাদারও লাগবে না। গুরুচাঁদ আপনিই করুণা করবেন। শুনে গোপাল কেঁদে ধরণীতে লুটালেন। পরে তারক তাঁকে বক্ষে টেনে নেন। এভাবে তিনি তারকচাঁদের কৃপা লাভ করেন। এতে তাঁর শক্তি আরো বৃদ্ধি পায়।
গোপালের কীর্তির কাজ সমূহ:
১) বিধবার বিবাহ দেয়া।
২) শ্রীশ্রী হরি লীলামৃত গ্রন্থ মুদ্রণের ব্যয় ভার বহন বাবদ৫০০.০০ টাকা দান।
৩) প্রমথ রঞ্জন ঠাকুরের বিলেতে ব্যারিষ্টারী পড়ার জন্য ১৪,০০০/= টাকা দান।।
৪) বাগেরহাটের পি.সি কলেজের উন্নয়নে ৫০০.০০টাকা দান।
২৫) খুলনার মতিয়াখালীতে ৪০ বিঘা জমির উপর হরি-গুরুচাঁদ আশ্রম প্রতিষ্ঠা।
৬) পশ্চিম বঙ্গে ঠাকুর নগরে 'ঠাকুর ল্যান্ড' প্রতিষ্ঠায় আর্থিক সহায়তা প্রদান।
৭) বিভিন্ন জনহিতকর কাজে বিভিন্ন ভাবে সহায়তা দান করেছেন।
মতুয়া ধর্ম প্রচার:
মতুয়া ধর্মদর্শ প্রচারে গোপাল সাধুজীর অবদান উল্লেখযোগ্য। গুরুচাঁদ ঠাকুরের প্রতি তার গভীর নিষ্ঠা ও ভক্তির কারনে তিনি অধ্যাত্ম শক্তির অধিকারী হয়েছিলেন। এর পর তিনি মতুয়া ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা বাদাঞ্চলে তিনি মতুয়া ধর্ম প্রচার করেছিলেন। এছাড়া গোপালগঞ্জ, বরিশাল, খুলনা, বাগেরহাট প্রভৃতি জেলায় তাঁর অসংখ্য ভক্ত শিষ্য রয়েছেন। শ্রীধাম ওড়াকান্দীর পাশ্ববর্তী গ্রাম ঘৃতকান্দী ও খোপড়া, দিঘড়গাতি গ্রামেও তার বহু শিষ্য আছে। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে পরীক্ষিত গোঁসাই, সূর্যকান্ত গোঁসাই, লাল চাঁদ গোঁসাই, হেম গোঁসাই, আভিলাষ গোঁসাই, সন্তোষ গোঁসাই, পুলিন গোঁসাই, রাজেন গোঁসাই প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। শিক্ষিত ভক্তদের মধ্যে আচার্য মহানন্দ হালদার, কুবের চন্দ্র বিশ্বাস, জগবন্ধু মিশ্র, কুমুদ রঞ্জন মজুমদার, নিত্যানন্দ মোক্তার বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। এছাড়াও আমার জানা- অজানা বহু ভক্ত আছেন তাঁদের নাম উল্লেখ করতে পারলাম না বলে ক্ষমা প্রর্থনা করছি। পরবর্তী কালে এসব হরি ভক্তরা মতুয়া ধর্ম প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রেখে জীবনে যশস্বী হয়েছেন। গোপাল সাধুজী ১৩৬৩ বঙ্গাব্দের ২৬ জৈষ্ঠ্য খুলনার মতিয়াখালীর আশ্রমে ইহলোক ত্যাগ করে নিজ ধামে গমন করেন।
হরি-গুরু চাঁদ আশ্রম প্রতিষ্ঠা:
১৩৩০ সালে ঠাকুর গুরুচাঁদ ভক্তবৃন্দ সহ লক্ষ্মীখালী যান। সেখান থেকে ফেরার পথে রূপসার কাছাকাছি, এলে একটা জায়গা দেখিয়ে গোপালচাঁদকে বলেন, গোপাল, এই জায়গাটা খুব মনোরম, এখানে একটা আশ্রম প্রতিষ্ঠা করতে ইচ্ছা হয়। অবশ্য বেশ কয়েক বছর আগে ঠাকুর বলেছিলেন, গোপাল খুলনায় আমার একটা বাড়ি করতে ইচ্ছ হয়। এবার ঠাকুর নিজেই জায়গাটা দেখিয়ে দিলেন। যাইহোক, ঠাকুরের কথায় সাধুজী বললেন- বাবা, টাকা কোথায় পাই? ঠাকুর বললেন- এখন থেকে আর জরিমানার টাকা ওড়াকান্দীতে দিওনা। পরে ঠাকুরের বাক্য রক্ষার্থে তিনি ভক্তদের আশ্রম প্রতষ্ঠার কথা জানালে অনেকেই টাকা দিতে প্রতিশ্রুতি দেন। রূপসা নদীর পশ্চিম তীরে বটিয়াঘাটা থানার অন্তর্গত মতিয়াখালীর লবণচারা নামক স্থানে ৪০ বিঘা জমি কিনে সেখানে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এই আশ্রম প্রতিষ্ঠায় শত শত ভক্ত শ্রম দিয়েছেন, অর্থ দিয়েছেন। অনেক মায়েরাও অর্থ দিয়েছেন বলে জানা যায়। সকলের নাম জানা এখন আর সম্ভব নয়। ঐ আশ্রমের নাম দেয়া হয়েছিল 'হরি- শুরু চাঁদ আশ্রম'। ভক্তরা এখানে পুকুরও দীঘি খনন করেন এবং তার চার পাশে ফুলের গাছ রোপণ করেন। মন্দির, বসতঘর, ছাত্রাবাস, ভক্তদের জন্য বিশ্রামাগার নির্মান করা হয়। মন্দিরের ঠিক সামনেই ছিল সাধুজীর ঘর। উত্তর পাশে ছিল চৌচালা একটা বড় ঘর। পূর্ব দিকে ছিল ছাত্রাবাস। এই ছাত্রাবাসে থেকে বহু ছাত্র শহরে পড়াশুনা করতেন। আশ্রমে একটা পাঠাগার ছিল। পাঠাগারের মধ্যে মাসিক পত্রিকা 'অনন্ত বিজয়' এর দপ্তর ছিল। পশ্চিম দিকে বড় দোচালা রান্না ও খাবার ঘর ছিল। ছোট পুকুর পাড়ে আঙ্গুর, বেদানা, আপেল, বেল, আতা, জামরুল প্রভৃতি ফলের গাছ লাগান হয়েছিল। বৃক্ষতলা এত সুশোভিত ছিল যে বহু লোক প্রতিদিন আশ্রম পরিদর্শন করতে আসতেন। অনেক বিদেশী ও গণ্যমাণ্য ব্যক্তি আসতেন। অনেকে আসতেন গোপাল সাধুজীকে দেখার জন্য। কেউ কেউ আসতেন নিজের শোক, তাপ, জরা ব্যাধি থোকে মুক্তির আশায়। আশ্রমে ৮/১০ টি গাভি ছিল পালনের জন্য। আশ্রমের প্রধান সেবাইত ছিলেন গুরুচাঁদের অন্যতম সেবাইত চিরকুমার নব কুমার রায়ঠাকুর (নব গোঁসাই)। ঠাকুর গুরুচাঁদ দেহ ত্যাগের পর তিনি সাধুজীর অনুরোধে এই আশ্রমে থেকে সার্বিক দেখাশুনা করতেন। আশ্রমে থেকে যারা পড়াশুনা করে খ্যাতিমান হয়েছেন তাঁদরে ৩৭ জনের নাম জানা গেছে। এই আশ্রমটি ছিল দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের নতুয়াদের একটি মিলন ক্ষেত্র। শ্রীধাম লক্ষ্মীখালীর বারুণী উৎসবের পরবর্তী ত্রয়োদশী তিথিতে এখানে উৎসব হতো। সাধুজী এখানে মাঝে মধ্যে এসে থাকতেন।
দুঃখের বিষয় এই সুন্দর আশ্রমাটি আজ আর নেই। সামান্য অর্থে আশ্রমটি বিক্রি হয়ে গেল। বহু মতুয়ার ত্যাগ, শ্রম, অর্থ সাহায্য আর চোখের জলে ধৌত আশ্রমটি হাত ছাড়া হয়ে যাজয়ে গেল। বহু কত ব্যথা পেয়েছেন আশ্রমাটাই হামলা। এখানে উল্লেখ্য, আশ্রমে থাকাকালীন যাওয়ায় ভক্তরা যে সাধুজীকে বলেছিলেন আশ্রমটি মতুয়াদের নামে লিখে দিতে। যে কারনই হোক সেটি তিনি করেননি। ফলে যা হাবার তাই হয়েছে। মতুয়াদের নামে থাকলে কেউ সেটি বিক্রি করতে পারষ্ট্রেট তিনি গোপালের চির বিদায়:
ঠাকুর গুরুচাঁদের আজ্ঞায় গোপাল সাধুজী হরিচাঁদের জন্ম জয়ন্তী পালনের জন্য বারুণী মোলান। শ্রীধামে ওড়াকান্দীর বারুণীর পনের দিন পর শুক্লা ত্রয়োদশী তিথিতে বারুণী উৎসব হয়। সেটা এখনো বর্তমান আছে। ১৩৬২ বঙ্গাব্দে লক্ষ্মীখালীতে যে বারুণী উৎসব হয়েছিল সেটাই ছিল গোপালের শেষ বারুণী উৎসব পালন। বারুণীতে লক্ষাধিক ভক্ত সমাগম হয়েছেল। বারুণী শেষে মন্দিরের দ্বারে বসে গোপাল অঝোরে কাঁদছিলেন। ভক্তগণ বিদায় নোবার সময়ও তাঁর বুকটা বিষাদে ভরে গিয়েছিল। ভক্তরাও চোখের জলে বিদায় নিচ্ছিলেন। গোপাল হয়তো অন্তরে বুঝেছিলেন লক্ষ্মীখালীতে এটাই তাঁর জীবনের শেষ বারুণী উৎসব। এজীবনে হয়তো আর কারো সাথে দেখা হবে না। আকার ইঙ্গীতে ভক্তদের সংগেও সেই ভাব ব্যক্ত করছিলেন। আর চোখের জলে ভাসছিলেন। কাউকে কাউকে উপদেশও দিচ্ছিলেন।
সবার উপরে মোর এই আকিঞ্চন।
অধম গোপালে যেন রাখিও স্মরণ।।
এবে আর কি বলিব সবে দেশে যাও।
গৃহ কর্ম কর আর হরি নাম গাও।। শ্রীশ্রী হরি গুরু চাঁদ ভক্ত চরিত্র পৃঃ ৪৪০/১
মহানন্দে আর বিষাদে বারুণীর সাতদিন কেটে গেল। এর পর গোপালের মধ্যে উদাসীন ভাব দেখা গেল। একদিন প্রভাতে গোপাল ধীরে ধীরে হেঁটে বেড়াচ্ছেন আর চারিদিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছেন। সবার কাছ থেকে যেন বিদায় নিচ্ছেন। সবকিছুর সংগে কত পরিচয়, কত ভালবাসা, কত স্মৃতি জাড়িয়ে আছে, আজ সব ফেলে বিদায় নিতে হচ্ছে। এক গভীর দুঃখ ও বেদনায় গোপালের হৃদয় দহিত হচ্ছে। বিদায় লক্ষ্মীখালী। বিদায় সবাইকে !! জীবনে আর দেখা হবেনা!!! ছেলে, মেয়ে, নাতি, নাতনী সবাইকে ডেকে বিদায় নিলেন খুলনা আশ্রমে যাবার জন্য । তাঁর মন কাঁদছিল। এটাই শের বিদায় যাত্রা। অন্যরা কিন্তু সেটা বুঝতে পারেননি। হয়তোবা তিনি বুঝতেও দেন নি। সবাইতে কাঁদিয়ে তিনি খুলনার আশ্রমে চলে গেলেন।
আশ্রমে এসেও তাঁর এই অবস্থা। সকলের সংগে বিষাদ মাথা স্বরে কথা বলতেন। প্রকারান্তরে বিদায়ের কথা বলতেন। বাবা গুরুচাঁদ বলে শুধু কাঁদেন আর হাই ছাড়তেন। ১৩৬৩ বঙ্গাব্দের ২৬ জ্যৈষ্ঠা (১০ জুন, ১৯৫৬) সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে নিজ দেশে চলে গেলেন। আশ্রমেই তাঁর দেহ সংকর করা হয়।
শ্রীমৎ নকুল চন্দ্র গোস্বামীর জীবন কথা
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের একনিষ্ঠ ভক্তদের মধ্যে নকুল চন্দ্র গোস্বামী অন্যতম। বাড়ি খুলল জেলার লক্ষ্মীকাটি গ্রামে। এটা দৌলতপুর থানার মধ্যে। ১৩০২ সালে তাঁর জন্য হয়। পিতার নাম দুর্গাচরণ পাল চৌধুরী হলেও তাঁর জন্য নমঃশূদ্রকুলে। ধনে মানে কুলশীলে দুর্গাচরণ মোটেই ক্ষুদ্র নন। তাঁর দুই ছেলের মধ্যে নকুলই ছোট। বড় ছেলেন নাম পঞ্চানন।
বাল্যকাল থেকে নকুল ছিলেন খুবই তেজস্বী। মাঝে মাঝে তিনি উদ্ভ্রান্ত হয়ে যেতেন। যশোর জেলার ডোমরা গ্রামে তাঁর মামাবাড়ি। কবি রসরাজ তারকচন্দ্র সরকার তাঁর মামা বাড়িতে মাঝে মায়ে আসনে। শিশুকালে তিনি মামাবাড়ি গেলে তারকের সংগে দেখা হয় এবং রসরাজ তাকে কোলে করেন। মহতের স্পর্শে মানুষ মহৎ হয়। তারকের স্পর্শে তাঁর ভাগ্যোদয় হল। জীবনে লেখাপড়া তেমন শিখতে পারেননি। ছোটবেলা থেকে তিনি সমবয়সী বালকদের নিয়ে নেচে নেচে হরি নাম করতেন। তবে দলের প্রধান ছিলেন নকুল। কোথাও কীর্তন বা মহোৎসব হলে বালকদল নিয়ে তিনি সেখানে যেতেন। তাদের দেখে সবার ভাল লাগত।
যশোর জেলায় কুলসুর নামে একটি গ্রাম আছে। সেই গ্রামে একদিন মহোৎসব হচ্ছিল। সেখানে নকুল গিয়ে ছিলেন। 'মহাসংকীর্তন' এর গান শুনে তার মন ভুলে যায়। তিনি ভাবে বিভোর হয়ে যান। গায়কদের কাছে তিনি বইটি চেয়ে নিয়ে যান। বাড়ি এসে গান আয়ত্ব করেন। মহোৎসবে গিয়ে গান করেন। তাঁর কণ্ঠে গান শুনে ভক্তরা মুগ্ধ হন। ধীরে ধীরে তিনি মতুয়ার দলে মিশে যান। এক সময় তিনি বিয়ে করেন। বিবাহের পর এক বছর গত হয়। তিনি বারুণীর সময় ওড়াকান্দী যাবার ইচ্ছা করেন। কেমন বারুণী হয়, কত লোক আসে, কীভাবে কি হয় সেটা দেখার জন্যই শ্রীধামে যান। বীরের মূর্তি নকুল সকলের আগে। দলে লোক প্রায় তিন শত। প্রায় সকলেই সম বয়সী। বীর রসে তাঁর ওড়াকান্দী আসেন। গুরুচাঁদের কাছে গেলে নকুলের কাছে পরিচয় জেনে ঠাকুর বলেন- চৌধুরী মশাই, এই মত বীরের দল চাই। তোমরা মাঝে মাঝে শ্রীধামে এসো। তোমরা আসলে শাস্তি পাই।
বিদায়কালে ঠাকুর তাঁকে বলেন- মধুমতি পার হতে তোমার পয়সা লাগবে না। এখন দল নিয়ে মনা কর। নকুল দল সহ সবাইকে নিয়ে মধমতি নানীর মঙ্গলপুরের ঘাটে এলেন। ঐ ঘাটে জেলেরা হে করছিল। কিন্তু জালে কোন মাছ পাচ্ছিল না। তারা সিদ্ধস্ত নিল- মতুয়ারা যদি এই ঘাটে আসে তবে প্রথা তাদের পার করে দেবে। তাহলে তারা বেশী মাছ পাবে। এমন সময় দূরে মহুয়াদের ডয়ার শব্দ প্রম কারা মহা খুশী হল। নকুল দল সহ ঘাটে এলে জেলেরা জোড় হাতে তাদের আহবান জানায় বিনা কময় পার করে দেবে বলে। নকুল বিস্মিত হলেন। গুরুচাঁদের কথা তাঁর মনে পড়ল। কোথায় এজাব্দী আর কোথায় মধুমতি ঘাট। ঘাটে এলে জেলেরা বিনা পয়সায় পার করে দেবে সেটা সর্বদর্শী জেনেছেন। সংগীরা বলল- হারে ভাই মমরা ঠকেছি। আমরা তাঁকে চিনতে পারিনি। সেখানে এক ভাবের বন্যাবয়ে গেল। আমাগে বুকিনি। এটি এলো। সবাই নৌকার উঠলেন। নকুল গান ধরলেন-
তোরা কে যাবি আয় পারে
তোদের পারের কড়ি লাগবে নারে।
আঁকার মধ্যে সবাই ভাবে মগ্ন। ভাবের তরঙ্গের সাথে নদীর তরঙ্গ একাকার হয়ে গেল। আরোহী, নাড়ি, মাঝি কারো যেন হুস নেই। প্রায় দুই ঘন্টা পরে নৌকা তীরে ভিড়লো। তারপর দলবল নিয়ে নতুন বাড়ি এলেন। এবার গুরুচাঁদকে দেখে তাঁর মন ব্যাকুল হয়েছে। ঘরে থাকতে পারেছেন না। সপ্তাহ খানেক পরে তিনি আবার শ্রীধামে গেলেন।
গুরুচাঁদের কৃপালাভ:
ঠাকুরকে প্রণাম করে নকুল বসে রইলেন। এক সময় ঠাকুর জিজ্ঞাসা করেন- কি হে নকুল, আবার কেন আসলে? উত্তরে নকুল বলেন-বাবা, এমনিই এসেছি। কিছু বলতে বা নিতে আসিনি বাবা। ঠাকুর হেসে বলেন-এ কেমন কথা বললে? কিছু বলবে না, কিছু নেবে না তবে বৃথা কেন এলে? ঠাকুরের কাছ থেকে একটু দূরে জ্ঞানী যজ্ঞেশ্বর বসে ছিলেন। তিনি নকুলকে ডেকে বললেন-তুমি খুবই সোজা লোক। দয়াময় গুরুচাঁদ তোমাকে দয়াকরে কিছু দিতে চাচ্ছেন তুমি তা থেকে সরে যাচ্ছ কেন? যজ্ঞেশ্বরের কথা শুনে তাঁর বোধদয় হল। তিনি পুনরায় ঠাকুরের কাছে এলেন। ঠাকুর তাঁকে বললেন- নকুল, আমার একটা কথা শোন। যা বলি অক্ষরে অক্ষরে পালন করো। আঠার মাস যাবৎ নারী সংগ করো না। নকুল ভাবলেন- এ আবার কোন জ্বালা হল? এক বছর নারীর কাছে যাবনা এটা কি পারা যায়? না পারি সেও ভাল কিন্তু পারব বলে কাল না পারলে সেটা খুব অন্যায় হবে। তাই ভেবে নকুল হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে বললেন- বাবা, আমাকে ক্ষমা করবেন। এটা আমি পারবো না। শুনে ঠাকুর খুব রেগে গিয়ে বললেন- কি বললিরে। কথা যদি না রাখবি তবে এখানে কেন এলি? যদি ভাল না থাকিস তবে আর ওড়াকান্দী আসিস না। যারা আমার কথা মানে তারই এখানে আসুক।
ঠাকুরের কী মহিমা সেটা বোঝার সাধ্য আমাদের নেই। কাকে কী বলেন, কি সে যে কি হয় তার কিছুই আমরা বুঝিনা। ঠাকুরের কথায় নকুলের মনে দুঃখ হল বটে কিন্তু বিষাদে তাঁর অশ্রু ঝরল। ঠাকুরকে বললেন- হে দয়াময় আমাকে আসতে বারণ করলেন। ঠিক আছে, যদি কোন দিন ডাকেন সেদিনই আসব না হলে আর আসব না। এই বলে ঠাকুরকে প্রণাম করে তিনি চলে এলেন। পথে চলতে চলতে ভাবলেন- কিসে ঠাকুরের বাক্য রক্ষা করা যায়। গৃহে যদি থাকি তাহলে নিশ্চই স্ত্রীর কাছে যেতে হবে। তাতে ঠাকুরের কথা রক্ষা হবে না। তার চেয়ে দেড় বছর দূরে দূরে কাটাব।
নকুল গৃহে ফিরলেন কিন্তু স্ত্রীকে ওড়াকান্দীর ঘটনা কিছুই বললেন না। উদাসীর মত বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে থাকেন আর হরিনাম করেন। তাঁর স্ত্রীও সাধ্বী সতী ও গুণবতী। স্বামীর তুষ্টে তিনিও তুষ্ট। মনে একটুও দুঃখ নেই তাঁর। এভাবে দুই বছর কেটে গেল। নকুল শ্রীধ্যমে না যাওয়ায় ঠাকুর শুরুচাদ খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অনন্ত কুমার নামে এক ব্যক্তি উনশিয়া গ্রামে বাস করেন। গুরুচাঁদ তাঁকে নকুলের কাছে পাঠালেন। তাঁকে বলে দিলেন-দেখতো গিয়ে কোথায় নকুল আছে? দুই বছর হয়ে গেল এখনও সে ওড়াকাব্দী এলনা। তাঁকে গিয়ে বল কর্তা ডেকেছে। ভীষণ দায়ে পড়েছি আমি। অনন্ত নকুলের বাড়ি গিয়ে ঠাকুরের ইচ্ছার কথা জানালেন। কয়েকদিন পরে যাবেন বলে তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন। দেরী হচ্ছে দেখে ঠাকুর পুনরায় 'আদু' নামে এক ব্যক্তিকে পাঠান। এবার নকুল আর দেরী না করে তাড়াতাড়ি শ্রীধামে গেলেন এবং কেঁদে আকুল হয়ে ঠাকুরের পায়ের উপর গিয়ে পড়লেন। বললেন- তুমি দয়াল, করুণাসিন্ধু, জোর করে ধরে এনে করুণা করাআমি তোমার কথা না শুনে বড় আপরাধ করেছি বাবা। তুমি আমায় ক্ষমা করে প্রাণে বল দাও প্রভু। শুনে ঠাকুর বলেন- ওরে পাগল, এবার ওঠ। কোন ভয় নেই। আমি যে তোর রয়েছি। এবার দেশে যা। দেশে গিয়ে সবাইকে হরিনাম দিবি। আর সব সময় শ্রীহরিকে স্মরণে রাখিস। তাঁর নাম নিয়ে থাকবি। সেই থেকে নকুল গুরুচাঁদের কৃপা লাভ করেন এবং হরি নাম প্রচারে ব্রতী হন।
যাদব মল্লিক কর্তৃক শক্তি দান:
গুরুচাঁদের কৃপা লাভ করে নকুল দেশের বিভিন্ন এলাকায় হরিনাম প্রচার করতে থাকেন। যশোর জেলার 'হিদা' গ্রামে তিনি নাম প্রচারে যান। সেই গ্রামে এক বাড়িতে মহোৎসব উপলক্ষ্যে বেশ কিছু মতুয়ারা আসেন। ঠাকুরের ভক্ত যাদব মল্লিক ও যাদব চালীও সেখানে যান। পার্শ্ববর্তী ঘরে নেপাল বিশ্বাস নামে এক ব্যক্তি ছিল। মতুয়াদের প্রতি সে খুব বিদ্বেষী ছিল। মতুয়ারা নাম গান করছে কিন্তু নেপাল সেদিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। ঠাকুরের লীলাতত্ত্ব কে বুঝতেপারে? যে বাদী তাকে দলে না এনে ছাড়ে না। দৈবক্রমে দুপুর বেলায় নেপালের ঘরে আগুন লাগে। সে সময় স্নানের জন্য মতুয়ারা পুকুরে যাচ্ছিলেন। ঘরে আগুন লাগায় চারিদিক থেকে লোকজন ছুটে এলো। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আগুনের প্রকোপ দেখে সবাই দাঁড়িয়ে থাকল, কেউ কাছে যেতে পারল না। সবাই হায় হায় করতে লাগল। পুড়ে বুঝি সব ছাই হয়ে যাবে। নিরুপায় নেপাল কেঁদে বোড়াতে লাগল। সংবাদ পেয়ে গোস্বামী নকুল সেখানে ছুটে এলেন। কারো অপেক্ষা না করে জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুহূর্তের মধ্যে।
ঘরের চালে উঠে গেলেন। বীর মূর্তি সে নকুল বজ্রকণ্ঠে বললেন- জয় হরিচাঁদ। নেপালকে দেখে বললেন- ওরে অজ্ঞান, ঘর রক্ষা পেতে হলে হরিচাঁদ বলে কাঁদ। আর শোন সব মতুয়াদের ভোজন করাবি। তাদের পূজন করবি। নেপাল কেঁদে স্বীকার করে বলল- হরিচাঁদকে চেনার শক্তি আমার নেই। আজকের বিপদে যদি রক্ষা পাই তবে মতুয়াদের নিয়ে মহোৎসব করাব। নকুল বললেন- শীঘ্র ভিজা কাঁথা আন, হরিচাঁদ বলে আগুন নিভাব। তাঁর কথায় দলে দলে লোক ভিজা কাঁথা ও জল নিয়ে এলো। জল ছিটিয়ে ও ভিজা কাঁথা চাঁপা দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে আগুন নিভে গেল। অগ্নি যুদ্ধে জয়ী হয়ে নকুল ঘরের চাল থেকে নীচে নেমে এলেন। তাঁকে দেখে নরনারী সবাই প্রেমাকুল হল। এদিকে যাদব মল্লিক ঘন ঘন নকুলের দিকে তাকাচ্ছেন। তাঁর মনে মহা ভাবের উদয় হলো। ভাবাবেশে তিনি নকুলকে বক্ষে টেনে নিলেন। কার্যগুণে নকুলের ভগ্যোদয় হল। বক্ষে ধরে গোস্বামী যাদব বললেন- নকুল রে, তুই আজ যে কাজ করলি হরিচাঁদের কৃপাগুণে ধন্য হয়ে গেলি।
যেকাজ করিলি তুই কিবা দেব আর।
তোরে দিনু সব শক্তি যা কিছু আমার।। শ্রীশ্রী গু.চ.পৃ: ৪৯১/২
কেঁদে নকুল বললেন- হে দায়াল গোঁসাই, আমাকে কৃপা কর, শক্তি চাইনা। শক্তি নিয়ে কী করব? যদি কৃপা পাই তবে রণে বনে কোনখানে ভয় পাইনা। অতঃপর মতুয়ারা স্নান করে মহোৎসবের বাড়ি গেলেন।
এমন সময় অশ্রুসজল নয়নে নেপাল এসে সবাইকে তার বাড়ি গিয়ে মহোৎসব করার আহবান জানালে গোস্বামী যাদব পর দিন সবাইকে নিয়ে তার বাড়ি যান। মহাভাবে নেপালের বাড়ি কীর্তন হল। যাদব গোস্বামীর অনুরোধে নকুল গান ধরেন-
মনে এক বাঞ্ছা ছিল ঘটলনা আমার।
আমার হৃদপদ্মে হরিচাঁদে-
সাজায়ে মিলাব চাঁদের বাজার।। -শ্রীশ্রী হরি সংগীত
গান শুনে মহাভাবে মত্ত যাদব মল্লিক নকুলের প্রতি আরো মুগ্ধ হলেন। মা যেমন সন্তানকে কোলে করেন তেমনি ভাবে তিনি নকুলকে ধরে কোলে ধারণ করে দোলাতে লাগলেন। তাঁদের ভাব দেখে উপস্থিত সবাই ভাবে অজ্ঞান। প্রহরকাল কীর্তন চলল। বেলা দুপুর হলে সবাই শান্ত হলেন। সবাই স্নান করে আসলেন। একমন চাউল পাক হল। সেই অন্নে পাঁচশত লোক আহার করল। সুন্দরভাবে নেপালের বাড়ি মহোৎসব হল। সেই থেকে নেপাল মতুয়া হল। তাঁর মন থেকে বিদ্বেষ দূরীভূত হল।
ভক্ত বাঞ্ছা পূর্ণকারী গুরুচাঁদ:
১৩৩৪ সালে ঠাকর গুরুচাঁদ যশোর ও খুলনা অঞ্চলে বিভিন্ন ভক্ত গৃহে ভ্রমণ করেন। সেই সময় গোস্বামী নকুল নিজ বাড়িতে ঠাকরকে নিতে চান। ঠাকুর তাতে সম্মতি দিলে তিনি বাড়ি দিয়ে ভাইদের গোস্বামী নকুল নিজেকেন। বাড়িতে তখন যে চাল ছিল তাতে কিছু টানাটানি হতে পারে সে জন্য এক সংগে আলোচনার যদি আসেন তাহলে পাকা ধান উঠে যাবে এবং কোন অসুবিধা হবে না তাঁর সাদা অকথা বলায় নকুল তাতে সায় দেন। পরক্ষণে আবার ভাবে আমি কী ভুল করেছি, দয়াময় গুরুচন যেখানে যান সেখানে তো সর্বঘট পূর্ণ থাকে, অভাব থাকবে কেন? আমি অভাবের চিন্তা করছি কেন?যা বোর হবে। এই ভেবে দাদাকে বলেন- দাদা তুমি চিন্তা করো না। ঠাকুর গুরুচাঁদ যেখানে যান সেখানে আবার কিসের অভাব? ইচ্ছাময়ের ইচ্ছায় বাধা দিতে নেই। তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ হোক।
ঠাকুর অন্তর্যামী, তাই বোধ হয় অন্তরে সবই জানলেন। ভক্তের পেছনে সব সমই তাঁর কৃপা হস্ত রয়। ভক্তকে শাস্তি দিতে তিনি সব সময়ই ব্যস্ত থাকেন। এদিকে ঠাকুরের আসতে কয়েকদিন মাত্র বাক আছে কিন্তু নকুলের কাছে সেটা শত বর্ষের মত মনে হল। দিবানিশি ঠাকুরের রূপ ধ্যান করছেন। একদিন তিনি স্বপ্নে দেখেন- তাঁর বাড়িতে যেন গুরুচাঁদ এসেছেন। একা নন, সাথে আর একজন। তাঁর মোহন মূরতি। অঙ্গ রেশম বরণ, শির হতে দীর্ঘ কেশ কটি পর্যন্ত বিলম্বিত। অরুণ নয়ন দু'টি করুণা পূরিত, দীর্ঘ বাহু, দেহে যেন এক অপূর্ব শোভা বিস্তার করছে। দেখামাত্র যেন প্রাণ কেড়ে নেয়। এ রূপের কাছে যেন সব রূপ তুচ্ছ। গোস্বামী নকুল এই রূপ দেখে এক দৃষ্টে চেয়ে থাকেন। অজানা ভাবের স্রোতে তিনি ভেসে চলেছেন। কেঁদে গুরুচাঁদের পায়ে পড়ে নকুল বলেন- আপনার সংগে কাকে এনেছেন আমাকে দয়া করে বলুন। মধুর হেসে ঠাকুর গুরুচাঁদ বলেন- এই যে মোহন মুরতিধারী আমার সংগে এসেছেন। তিনি আমার পিতৃদেব শ্রীহরি ঠাকুর। শীঘ্র তাঁকে আসন দেও। বহু ভাগ্যে তুমি তাঁর দর্শন পেলে। ঠাকুরের কথা শুনে বিস্মিত, পুলকিত গোস্বামী নকুল কেঁদে কেঁদে দু'টি আসন পাতলেন। দুই প্রভু দুই আসনে বসলেন। নকুলের মনে আনন্দ আর ধরে না। এমন দিন কী আর পাওয়া যাবে? নকুল মাটিতে লুটিয়ে মাথা কুটছেন আর জয় হরিচাঁদ, জয় গুরুচাঁদ বলছেন। কোথায় রে জগৎবাসী তোরা দেখে যা। এমন সুদিন তোরা আর পাবিনারে। হরি-হর এক সংগে নেমে এসেছে ভুবনে। এভাবে সাধুজী ভাবের আলাপে আছেন। কিছুক্ষণ পর দয়াময় হরিচাঁদ অন্যত্র যেতে চান। নকুল মনে মনে ভাবেন- এ রতন যদি একবার চলে যায় তবে আর পাবনা। হরি বিনে বেঁচে থেকে কী লাভ? নকুল হরি চাঁদের পায়ের উপর পড়ে কেঁদে বলেন- যেওনা প্রভু, তুমি চলে গেলে এই দন্ডে আমি জীবন ত্যাগ করব। হে দয়াময়। দয়াকরে তুমি এই ঘরে থাক, নাহয় এই আভাগারে সংগে নিয়ে যাও।
এভাবে গোস্বামী নকুল কাঁদা কাঁদি করছেন হটাৎ ঈষৎ আভাসে তিনি দেখলেন গুরুচাঁদের অঙ্গে হরি চাঁদ লুকালেন। এ দৃশ্য দেখেই তাঁর ঘুম ভেঙ্গে যায়। সজাগ হয়ে তিনি কাঁদতে লাগলেন। এরপর তিনি শ্রীধামে চলে যান। ঠাকুরকে দেখে তিনি কাঁদতে থাকেন। ঠাকুর গুরুচাঁদ তাঁকে বলেন- কি নকুল কাঁদ কেন? তোমার বাড়িতে যাব সেটাত্যে বলেছি। তবে আর চিন্তা কী? এবার সুস্থ হও।
২০৪
দুইদিন পর ঠাকুর রওনা হলেন। গোপীনাথ পুর, সুচীডাঙ্গা হয়ে ঠাকুর এলেন বড়দিয়া গ্রামে হৃদয় ডাক্তারের বাড়ি। এখানে এসে ঠাকুর নকুলকে বলেন- নকুল তুমি আগে বাড়ি যাও। আমি পরে আসছি। নকুল বাড়ি চলে গেলেন। দুই দিন অতিবাহিত হল তবুও ঠাকুর না আসায় আকুল হয়ে নকুল ছুটলেন। পদুমা গ্রামে গিয়ে ঠাকুরের দেখা পেলেন। তাঁকে দেখে ঠাকুর বলেন- কী নকুল এত ব্যস্ত কেন? আমিতো বলেছি তোমার বাড়ি যাব। বরং আমার সাথে চল, কয়েক দিন ঘুরে আসি। তোমার ক্ষেতে পাকা ধান রয়েছে। সেই ধানের চালের ভাত আমি খাব, শুনে নকুলের চোখে জল এল। মনে ভাবলেন ঠাকুর অন্তর্যামী তাই সব জেনেছেন। সেজন্যই দিন ক্ষেপণ করছেন।
দশ দিন কাটাবার পর ঠাকুর নকুলের বাড়ি গেলেন। স্বপ্নে দেখার মত ঘরে আসন করলেন। এ কয়দিনে নতুন ধানের চাল করা হয়েছে। সব চালই মতুয়াদের সেবায় ব্যয় হয়ে গেল। একদিন পর ঠাকুর শ্রীধামে যেতে চান এবং নিজ আসন থেকে উঠে দাঁড়ান। তখনই নকুলের স্বপ্নের কথা মনে পড়ে যায়। অমনি মাটিতে লুটিয়ে কেঁদে বলেন- দয়াময় যেওনা। তুমি গেলে আর তোমায় পাবেনা। ঠাকুর উঠে দাঁড়াতেই নকুল স্বপ্নে যা দেখেছিলেন সেইরূপ বাস্তবেও দেখলেন। গুরু চাঁদের অঙ্গে এক মোহন মূর্তি মিশে গেল। নকুল গড়াগড়ি দিতে লগলেন। ঠাকুর তাঁকে অভয় দিয়ে শ্রীধামের উদ্দেশ্যে নৌকায় উঠলেন। গোস্বামীর মৃত্যুর তারিখ পাওয়া যায় না।
শ্রীমৎ যাদব চন্দ্র ঢালীর জীবন কথা
যশোর জেলার কালিয়া থানার অন্তর্গত লোহারগাতি গ্রামে ১২৮০ সালের কার্তিক মাসে যাদব চন্দ্র ঢালীর জন্ম হয়। নমঃশূদ্র কূলে জন্ম এই মহাত্মা ছোট বেলা থেকেই খুব মেধাবী ছিলেন। একবার পড়লে- তা সহজেই মুখস্ত হয়ে যেতো। সে কারণে অন্য ছাত্ররা তাঁকে 'শ্রুতিধর' বলে ডাকতো। তবে তিনি বেশীদূর শিক্ষা লাভ করতে পারেননি। সামান্য লেখাপড়া শেখার পর পিতার আদেশে সংসারে প্রবেশ করেন এবং আপন বুদ্ধিও মেধার শুনে তিনি অল্প দিনেই সংসারে বেশ উন্নতি করেন। তিনি বয়সে যুবক হলেও জ্ঞানেতে প্রবীণ ছিলেন। জ্ঞানী বলে সমাজে বেশ মান্য ছিল।
এভাবে কিছুদিন অতিবাহিত হল। ইতিমধ্যে তিনি কবিরসরাজ তারক চন্দ্রের নাম শোনেন এবং তাঁকে দেখার জন্য মন ব্যকুল হয়। তাঁর বাড়ি থেকে কালিয়া গ্রাম বেশী দূর নয়। একদিন কালিয়া গ্রামে কবি রসরাজ কবি গান গাইতে আসেন। পরমানন্দে যাদব সেখানে হাজির হন। উদ্দেশ্য তাঁর কবি গান শোনা। তারকের গান শুনতে শুনতে তিনি মুর্ছা যান। সুস্থ হলে তিনি বাড়ি চলে আসেন কিন্তু তারকের সংগে কোন কথা হয় না।
১২৯৪ সালে তারক পুনরায় কালিয়ায় কবি গান করতে আসেন। সেখানে পুনরায় যাদব যান। গান শোনার পর থেকে তাঁর মন উদাস হয়। কাজে কোন শাস্তি পাননা। তারককে মনে করে সর্বদা হাই ছাড়েন। বেদনায় বুক ফেটে যায়, চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে। তিনি তখন বয়সে কিশোর। ১২৯৫ সালে তাঁর পিতা মারা যায়। নাবালক ভাইয়েরা ও সংসারের বোঝা এখন তার উপর। তিনি সযত্নে ভাইদের প্রতিপালন করেন।
২০৫
যার যে মানুষ তার চেনা আছে আগে। চেনা জনে চিনিতে বা কতক্ষণ লাগে।। শ্রীশ্রী ৩.চ.পৃঃ ৫২৭/২
হরিভক্ত অক্ষয়, তারক চন্দ্র সহ বহুভক্ত একদিন লোহারগাতি আসেন। ভাবময় ভাবুকেরা সব সময় ভাবে মত্ত থাকেন। ভাব দিয়ে তাঁরা ভাবুকদের টেনে নিয়ে যান। তারকচন্দ্র এসেছেন শুনে যাদব সেখানে যান। নাম গান শেষ হলে যাদব গিয়ে তারকের পায়ে প্রণাম করেন। কিশোর বালককে এভাবে প্রণাম করতে দেখে তারকের মনে চিন্তা হল- এ বালক এতদিন কোথায় ছিল? তারক তাঁর প্রতি শুভ দৃষ্টি করেন। যাদবও তাঁর দিকে চেয়ে থাকেন। কি যেন কি মোহিনীভরা দৃষ্টি তাঁর চোখে। কালিয়ার স্মৃতি তাঁর মনে ভেসে উঠলো। সহসা যাদব সেখান থেকে পালিয়ে যান।
বাড়ি এসে যাদব মনে মনে চিন্তা করলেন- এ আমি কী করলাম। কেন পালিয়ে এলাম? আগে থেকে তাঁর মন উদাসী ছিল। উদাসী মনে এখন দারুণ ব্যথা বাজল। তারকের জন্য তাঁর মন কাঁদতে লাগল। কোথাও শান্তি পাচ্ছিলেন না। কিছুদিন বৈষ্ণব সেজে বৈষ্ণব আচারে একাদশী, উপবাস, মালা জপ, নিরামিশ আহার, তেলহীন স্নান প্রভৃতি কঠোর ভাবে পালন করেও মনে এক বিন্দুও শাস্তি পেলেন না। এরপর তিনি কালিয়ার শ্রীশ বাবু ও বেন্দা গ্রামের গুরুনাথ সেনের কাছে গিয়ে মনোব্যথা জানালে তাঁরা তাঁকে বলেন- মধু মাখা হরিনামই শ্রেষ্ঠ। তুমি অবিরাম হরিনাম জপ কর। মনের মানুষ যার মন চুরি করেছে ব্রতাচার করে কী হবে? মন মানুষের সংগে দেখা হলে বরং মনের বেদনা দূরে যায়। তারক তোমার মন চুরি করেছে তাই তাঁকে বিনে তোমার ব্যথা ঘুচবে না। তুমি তাঁর কাছেই যাও। তবুও যাওয়া হল না।
যে যাকে চিন্তা করে সে তাকেই চায়। চিন্তাবেড়ি পায় দিয়ে তাকে ঠিকই টেনে নেয়। মাতাল যেমন মদের নেশায় ভুলে থাকে, নেশা ছুটে গেলে বুকে ব্যথা বাজে। তাই বারে বারে মদ খায় শাস্তি মেলে না। যাদবের ব্যাপারটা তাই হলো। এ গ্রাম সে গ্রাম ঘোরেন, হরিনাম করেন কিন্তু কোনরূপ মনে শাস্তি পান না। হঠাৎ একদিন এক মহোৎসবে তারকচন্দ্র আসলেন ভক্ত সহ। মহাভাবে নাম সংকীর্তনে তিনি মত্ত। নেচে নেচে হরিনাম করছেন। সারা অঙ্গ দিয়ে যেন 'ভাব' ফুটে উঠেছে। নাচছেন, কি কি করছেন কোন জান তাঁর নেই। এমন মোহনীয় নৃত্য দেখে যাদবের মন পাগল হল। কোন কিছু না বলে তিনি আবার ঘরে ফিরে এলেন। গোস্বামী তারক তাঁকে যতই ধরতে চান যাদব ততবারই পালিয়ে যান, ধরা দেন না। দেহ নিয়ে যান বটে কিন্তু মন থাকে তারকের স্থানে। বাড়ি এসেও দিবানিশি তারকের ধ্যানে মগ্ন থাকেন।
ভবানীপুর গ্রামে আনন্দ মন্ডল নামে জনৈক ভক্তের বাড়ি। তিনি তারকের শিষ্য। তাঁর বাড়ি মহোৎসবে যাদবকে নিমন্ত্রণ করেন। স্বামী মহানন্দ পাগল, তারকচন্দ্র, অক্ষয় এই তিন মহাত্মা সেখানে উপস্থিত। যাদব পিয়ে যাষ্টাঙ্গে তাঁদের প্রণাম করলেন। তারকচন্দ্র তাঁর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। চোখে চোখে পূর্বে চেনা থাকলেও আজ কথায় পরিচয় হল। তারক বহু যত্নে তাঁকে কাছে
২০৬
বসালেন। নিজ হাতে তাঁর পাতে পায়সান্ন প্রসাদ দিলেন। প্রসাদ পেয়ে যাদব ধন্য হলেন। মনে তাঁর শাস্তি হল তাঁর ব্যথা দূর হল। এর পর সব বৈষ্ণব আচার বিসর্জন দিলেন। দিনে দিনে তাঁর অনুরাগ বাড়তে লাগল। তারক যেখানে যান তিনি সেখানেই যাদবকে ডেকে নেন। যাদবও সেখানে যান। তখনও তিনি জানেন না ওড়াকান্দী কি আছে বা কে থাকেন। তারক চন্দ্র বারবার যাদবকে তাঁর সংগে ওড়াকান্দী যেতে বলেন। যাদব বলেন- ওড়াকান্দী কি আছে? কবি বসরাজ বলেন- ওড়াকান্দী সবই আছে। কী নেই বল। বিশ্বাস করে তুমি যদি একবার সেখানে যাও তোমার চোখের অন্ধকার দূর হয়ে যাবে। তবুও যাদবের মনে সন্দেহ যায় না।
এ সময় তাঁর এক পুত্র জন্যে কিন্তু স্ত্রী 'গ্রহণী' (কঠিন উদরাময়) রোগে আক্রন্ত হন। ওঝা, বৈদ্য, ডাক্তার, কবিরাজ দেখিয়েও কাজ হয়না। ক্রমে রোগ বৃদ্ধি হয়। পাইক পাড়ার 'হরিঠাকুরের বার' হয়েছে শুনে তাঁর স্ত্রীকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হল। 'বার" হয়েছিল বিশ্বেশ্বর নামে জনৈক ব্রাহ্মণের। তার দেয়া বিধি পালন করে রোগ সামান্য প্রশমিত হল বটে কিন্তু সারল না। ক্রমে তাঁর স্ত্রীর শরীর ক্ষীণ থেকে ক্ষীণ হতে লাগল। এমন সময় তারক চন্দ্র হটাৎ করে এক দিন লোহারগাতি যাদবের ঘরে এলেন। তাঁর স্ত্রীকে দেখে তারক বলেন- মাকে একেবারে মেরে ফেলেছো? তোমার কেমন প্রাণ ভেবে পাইনে। কোথায় যাও, কী কর দিশে পাওনা। 'বার' ধরে রোগ সারা যায় কী করে বুঝলে? ওসব ছেড়ে দিয়ে আসল পথ দেখ। বারে বারে বলেছি ওড়াকান্দী যাও, তাও গেলে না। অতঃপর তারক চন্দ্র রোগের বিধান দিলেন। তাতে রোগ সেরে গেল। বিস্মিত যাদব তাই মনে মনে ভবলেন- গোঁসাই কেন ওড়াকান্দী যেতে বলেন? ওড়াকান্দী কী আছে কিছুই জানিনা। ঠাকুরের সংগেও আমার পরিচয় নেই। কি জানি কোন ভাবে ঠাকুর কী বলেন। তাঁর মনে বহু সন্দেহ। তবে ইচ্ছা হল তারকচন্দ্র যদি সংগে নেন তবেই যেতে পারেন। তাঁকেই গুরু বলে মানেন। এভাবে কিছুদিন চুপ করে থাকেন।
বারুণীর কিছুদিন পূর্বে তারকচন্দ্র একা হেঁটে লোহারগাতি এলেন। যাদবকে বলেন- শোন যাদব, আমার কথা নেও। আমি বারুণীর আগে তোমার বাড়ি আসব। আমার সংগে তোমাকে ওড়াকান্দী নিয়ে যাবো। যাদব স্বীকার করেন।
যাদবের শ্রীধাম ওড়াকান্দী গমন ও চতুর্ভুজ মূর্তি দর্শন:
বারুণীর দিনে কবি রসরাজ তারক চন্দ্রের সংগে যাদব ওড়াকান্দী গেলেন। এসময় শ্রীধাম তীর্থক্ষেত্রে পরিনত হয়। শান্তির পরশ পেতে দলে দলে লোক আসে। বন্যার স্রোতের মত ভক্তরা শ্রীধামের পুণ্যভূমিতে অগ্রসর হন। শ্রীধামের নিকটে আসতেই গোস্বামী তারকের ক্রমে ভাবান্তর হল। আবিরল ধারায় অশ্রু ঝরতে থাকে। ভাবের তরঙ্গে যেন ঢলে পড়ে যান। মনে হয় তখনি পতন হবে। পতন মুহূর্তে যাদব তাঁকে ধরেন। প্রেমের আগুনে জারা তারকের প্রাণ। শ্রীধামের যত কাছে আসেন ততই আরো জ্বলে ওঠে। তারকের পরশে যাদবের দেহ অসাড় অবশ হয়ে যায়। এভাবে ক্রমে ধামে উপস্থিত হন। যাদবের চিত্ত প্রেমে পুলকিত হয়। এ সময় গোস্বামী তারক একটু সুস্থ হন এবং যাদবকে ডেকে বলেন- ওরে যাদব, মানুষ দেখবি যদি আমার কাছে আয়। এই বলে হাত ধরে টেনে নিয়ে
২০৭
শুরুটাদের কাছে উপস্থিত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। যাদবও ভূমিতে পড়ে প্রণাম করলেন। নিজের অগোচরে তাঁর চোখ দিয়েও অঞ্চ করে যখন ঠাকুরকে দেখতে গেলেন, মহাভাবে তাঁর ঝরতে লাগল। প্রথমে কলেখেন গুরুচাঁদ কই? চতুর্ভুজ মূর্তিধারী এ লেনে মানুষ বসে আছেন। গেল। আাদরা পদ্ম হাতে শোভা পাচ্ছে। এই অপূর্ব মূর্তি দেখোদব ফুকারিয়ে কেঁদেই। অঝোরে জল শশুভেচত্রীণলনা ক্ষণিক মাত্র দেখা দিয়ে সে রূপ অন্তর্হিত হল। যাদব ফুকারিয়ে কেঁদে উঠলেন। গুরুচাঁদ ভবন তারককে ডেকে বললেন- এ দেখি এক সামাজিক লোক। একে কেন ধরে নিয়ে আসলে? তারক তখন তারককে মেলেন- বাবা, সবই তোমার, দয়াকরে তুমি যাদবকে রেপ কবো। ঠাকুর সদর হলেন এবং যাদবকে ওড়াকান্দীর প্রতি মান্য রাখতে বললেন। তারকের কল্যাণে আর যাদবের ভক্তিগুণে তিনি আজ চতুর্ভুজ মূর্তি দর্শন করলেন। এরপর থেকে যাদব মাঝে মাঝে ওড়াকান্দী আসতেন। গুরুচাঁদ তাঁকে বহুভাবে দয়া করেছিলেন। তিনি হয়েছিলেন আধ্যাত্মিক শক্তি সম্পন্ন মানুষ।
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদের বিরাট রূপ ধারণ:
যাদব চন্দ্র ঢালী ও যাদব চন্দ্র মল্লিক (পদুমা) এই দুই গোস্বামীর মধ্যে খুবই অন্তরঙ্গতা ছিল। যেখানে যেতেন দু'জন প্রায়ই এক সংগে যেতেন। উভয়ই বংশীয় ও সম্মানীয় ছিলেন। একবার দু'জন মিলে ওড়াকান্দী গিয়ে ঠাকুর গুরুচাঁদকে প্রণাম করেন। দু'জনকে দেখে ঠাকুরও খুব খুশী হন। তাঁদের সাথে তত্ত্ব কথা বলে সারা রাত কাটিয়ে দিলেন। ঠাকুরের মুখবাক্য শ্রবণ করে দু'জন প্রেমানন্দে ভাসলেন। সারারাত কাটিয়ে ভোরবেলা দু'জন মিলে পুকুর পাড়ে যান। তাঁরা পুকুরের পশ্চিম পাড়ে বসেন। তাঁরা দেখেন ঠাকুর পূর্ব পাড়ে একাকী আপন মনে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। এসময় সেখানে অন্য কেউ ছিলেন না। যাদব ঢালী দেখেন ঠাকুর গুরুচাঁদের বদলে সেখানে আছেন সুদীর্ঘ বিরাট শরীর বিশিষ্ট এক শক্তিশালী পুরুষ। দীর্ঘ বাহু, দীর্ঘ পদ, ভয়ঙ্কর চেহারা তাঁর। দৃষ্টি- ভ্রম হয়েছে বলে তিনি চোখ মুছলেন। পুনরায় একই পুরুষকে দেখেন। বারবার দেখে তাঁর সন্দেহ দূর হল। হতজ্ঞান হয়ে তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন। যাদব মল্লিক তাই দেখে তাঁকে ধরে তোলেন এবং শুশ্রূষা করেন। জ্ঞান ফিরে পেয়ে তিনি যাদব মল্লিককে সব খুলে বললেন। শুনে তিনি বলেন-গুরুচাঁদ সাধারণ মানুষ না, বিরাট পুরুষও বটে। তোমার ভাগ্যগুণে দর্শন পেয়েছো। সে জন্য তুমি ধন্য।
সর্বদশী গুরুচাঁদঃ
গোস্বামী যাদব ঢালীর দুই পুত্র। জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম কার্তিক ও কনিষ্ঠ জনের নাম গণপতি। তারকচন্দ্রের বরে গণপতির জন্ম হয়েছিল। এক মাত্র পুত্র পেয়ে যাদব দম্পতি সুখী নন তাই তাঁরকের কাছে পুত্র বাঞ্ছা বর চান। তারক তাঁদের এক বছর নারী সংগ না করতে এবং সুপবিত্র থাকতে বলেন। যাদব বলেন- এটা আমার পক্ষে পালন করা মোটেই সম্ভব না। বারে বারে তারক এই কথা বলেন এবং যাদব অস্বীকার করেন। মহা শক্তির আধার কবি রসরাজ তরক চন্দ্র রুষ্ট হয়ে বলেন-
২০৮
বারে বারে মোর কথা তুই না শুনিলি।।
আচ্ছা দেখি কাম শক্তি কত বড় বলী।।
বর্ষকাল তোর দেহে কাম নাহি রবে।
চেষ্টাকরে এইবার দেখ গিয়ে তবে।। শ্রীশ্রী ৩.চ.পৃ: ৪৩১/২
গোস্বামী তারকের বাক্য অলঙ্ঘ্য। যাদবের ক্ষেত্রে ঘটলও তাই। বর্ষকাল ব্যাপী তাঁর দেহে কাম শক্তি লোপ পেল। স্বামী-স্ত্রী দু'জন পবিত্র ভাবে কাটাবার পর গণপতির জন্ম হয়। তাকে পেয়ে সবাই খুশী হলেন। এবার আসল কথায় ফিরে আসি।
পুত্র হবার পর যাদবের ওড়াকান্দী যাওয়ার ইচ্ছা হল। ঠাকুরের বাণী আছে পুত্র হলে ইলিশ মাছ ও কন্যা হলে কাৎলা মাছ ঠাকুরকে দিতে হয়। তাতে পুত্র কন্যার আয়ু ও যশ বৃদ্ধি পায়। সেই ভাবে তাঁরা ওড়াকান্দী রওনা হলেন। যাদব মল্লিককেও সংগে নিলেন। পথে চারটি ইলিশ ও দু'টি কাৎলা মাছ কিনে নিলেন। এদিকে ঠাকুর বাড়িতে কুটুম্ব এসেছেন। চাঁদসীর ডাক্তার ঠাকুরের কুটুম্ব। শশীভূষণ ঠাকুরের বিয়ে হয়েছিল ঐ পরিবারে। যাইহোক কুটুম্ব এসেছেন, বাড়িতে মাছ নেই। এখন কুটুম্বদের কী খাওয়াবেন সেই দুশ্চিন্তায় সবাই মরে যাচ্ছেন। অগত্যা ঠাকুরের কাছে জানান হল। ঠাকুর বললেন- ওরে অন্ধের দল, চুপ করে থাক। কি দিয়ে কি করে হরি বসে বসে তাই দেখ। কল্পবৃক্ষমূলে বসেও তোদের আশা ভরসা থাকল না? অবিশ্বাসীদের আশা যায় না। আমি তো দেখি একটু পরেই মাছ আসছে। তোরা বসে বসে যে কী চিন্তা করিস্ বুঝিনা বাপু। তাঁকে একবার ভেবে থাকনা দেখি সে কী করে। ভাবিলে ভাবনা সিদ্ধ পারিলে ভাবিতে। আর যে করে হরি চিন্তা, হরি করে তার চিন্তা।
বলতে বলতে দুই যাদব ছয়টি মাছ নিয়ে হাজির। তাই দেখে সবাই ঘটনা বললে তিনি প্রেমে পুলকিত হন। অনেকেও একথা জেনে বিস্মিত হলেন। সারারাত সেখানে এক ভাবের ঢেউ বয়ে গেল।
বাইরের প্রাঙ্গণে একটা নতুন ঘর তোলা হচ্ছে। সকাল বেলায় ঠাকুর সেখানে গেলেন। ঠাকুরের ভাব বোঝা দায়। সারাদিন ভক্তদের সংগে কাটালেও ঠাকুর প্রতিদিন সাংসারিক কাজগুলি দেখাশুনা করতেন। প্রাঙ্গণে যাবার সময় তিনি দুই যাদবকে ডাক দিলেন। তাঁরা এলে ঠাকুর বলেন- তোমরা দু'জন নতুন ঘরের পোতা সমান কর আমি হরিকথা বলি। দুই গোস্বামী উৎসাহভরে কাজ করতে থাকেন। ঠাকুর বললেন- দেখ, কাজ করলে কাজী আর না করলে পাজী। অকেজো অলস যারা তারাই পাজী এক স্থানে এক সাধু বাস করতেন। প্রায়ই চুপচাপ বসে থাকতেন আর একটা ঝিনুক দিয়ে বসে বসে মাটি খুঁড়তেন। অন্য কোন কাজ করতেন না। যদি কেউ তাঁকে প্রশ্ন করতো সাধু হেসে বলতেন- শোন বাবা, প্রভুর রাজ্যে বাস করে কেন চোর হব? তিনি দুই খানি হাত দিয়েছেন মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে হাতের খাজনা দিচ্ছি। তাই বলছি কাজ করা ভাল। অলসতা করোনা।
২০৯
এরপর তিনি (ঠাকুর) তারকচন্দ্রের প্রসঙ্গ এনে বললেন- শোন যাদব তারকের মূল্য এই নমঃজাতিরা জানেনা। তাকে চিনতো উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা। বাজা, রাজ চক্রবর্তী এরাই তারককে মান্য নিতা তারকের ভক্তি ছিল লোচনের প্রতি। একবার তারক কবিগান করার জন্য কালনা বাজারে যান। সংগে তাঁর বার জন দোহার। তাঁরা এক সংগে ওঠা-বসা, আহার সবই করতেন। জলপানের জন্য তাঁদের পাঁচ সের চিড়া ও তিন সের গুড় দেয়া হয়। ঠিক সেসময় হঠাৎ লোচন এসে হাজির। তাঁকে পেয়ে সবাই খুব খুশী। কিন্তু সবাই ভাবলেন তিনি কেন এখানে এলেন? তাঁকে বিনয়ের সংগে চিড়া গুড় খেতে দিলে তিনি সব খেয়ে শেষ করলেন। দোহারদের জন্য কিছুই থাকল না। অবশেষে তাঁরা পাকঘরে গিয়ে অন্ন ব্যঞ্চনাদি পাক করলেন। কোলা গ্রাম নিবাসী ভোলানাথ গোস্বামী লোচনকে ডাকতে গিয়ে দেখেন তিনি পাত্র নিয়ে চাটাচাটি করছেন। বিস্মিত হয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করেন কি করছেন গোঁসাই? সবই খেয়েছেন। কিছুতো অবশিষ্ট নেই? শুনে লোচন বলেন- বহুদিন এমন ভাল খাবার জোটেনিতো তাই ক্ষিদের গৌরবে সব খেয়েছি। আর শোন, সাধু আর পাখিতে খেয়ে কিছুই রাখেনা। ভোলানাথ বলে- অন্ন প্রস্তুত, ক্ষুধা থাকলে খেতে চলুন। শুনে লোচন হেসে বলেন- ভাল কথা বলেছ। ক্ষুধা নিয়ে কষ্ট পাব কেন? দাও অন্ন খাই। এই বলে বসে পড়লেন। তাঁর খাদ্য খাওয়ার ইচ্ছা দেখে ভোলানাথের রাগ হল। এই মাত্র সব চিড়ে গুড় শেষ করে আবার ভাত খেতে বসেছে। এত খাওয়াতো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এ দৈত্য কি দানব হবে বুঝলাম না। ভোলানাথের ক্রদ্ধ ভাব দেখে লোচন হেসে বললেন- না ভোলা, তুমি চিন্তা করো না। সব ভাত খেতে আমার মোটেই কষ্ট হবে না। শুনে ভোলা আরো রুষ্ট হলো।
এমন সময় তারক সেখানে এলো এবং ভোলানাথকে বললেন- ভোলা, গোস্বামীর লীলা খেলা তুমি কিছুই জান না। ভক্তিভরে ডাল ভাত সবই আন। শুনে দোহাররা ডাল- ভাত যা ছিল সবই এনে দিলো। লোচন অনায়াসে সব খেয়ে ফেললেন। তা দেখে তারকের চোখে জল এল। খাওয়া শেষ করে লোচন চলে গেলেন। সেদিন তারক সহ অন্যান্যরা অনাহারে গান করেন। সেদিন যে গান হল তা বর্ণনাতীত। স্রোতাগণ মোহিত হয়ে গান শুনেছিল। অপূর্ব ভাবের বন্যা বয়ে গিয়েছিল সেখানে। তাঁর গান শুনে নর-নারী সবাই মুগ্ধ।
একটু থেমে ঠাকুর আবার বলতে শুরু করেন। তারকের কথা তো শুনলে এবার আমি ছড়া বলবো সে ছড়া তারক কোন দিন কানেও শোনেনি। কিছুক্ষণ দেরী কর, নিজেরাই দেখতে পাবে। সবাই নীরব হলেন। কিছু সময় পরে এক অপূর্ব ঘটনা ঘটল। এক নারী এসে কেঁদে ঠাকুরের পায়ে পড়লো। মহাক্রোধে ঠাকুর তার চুল ধরে মারতে লাগলেন। আরক্ত নয়নে ঠাকুর তাঁকে বলেন- ওরে দুষ্ট আজ কাঁদিস কেন? যার গায়ে এতদিন তেল দিয়েছিলি তাকে আন্। যার গুণে ছেলে পেলি? তাকে ভুলে ব্যাভিচারী দুষ্টকে গোঁসাই বানিয়েছিস। যার জন্য পুত্র এলো তার মান্য নেই। এবার আসল পুত্রের কর্তা পুত্র নিয়ে যাচ্ছে, আমি তার কী করব? চলে যা পাপিনী এখান থেকে। উভয় যাদব বুঝতে পারছেন না কেন ঠাকুর এত রেগে আছেন? আবার জ্ঞিাসাও করতে পারছেনা। অন্তর্যামী ঠাকুর অন্তর জেনে উভয় যাদবকে বলতে লাগলেন- দু'জনেই শোন, এই নারী অত্যন্ত সরল। দুষ্টের ছলা কলা কিছুই বোঝে না। ওর সরলতার সুযোগে এক দুষ্ট ওর বাড়িতে থেকে গুরু সেজে সাধু বেশে মহা সুখে পূজা পাচ্ছে। আর
২১০
ঐ পাপিণী তার অঙ্গে নিত্য তেল ঘসছে। যেদিন থেকে এই নারী এই কাজ করছে সেদিন থেকে ওর পুত্র অসুখে পড়েছে। যজ্বর রূপে কাল তাকে নিতে চাচ্ছে। তেল ঘসা ঘসির ফল হচ্ছে এই। আমি এর তী করব? রাগের সাথে সেই নারীকে বলেন- বল সবার সামনে, একথা সত্যি কি না? কত কষ্টে তোর স্বামী গৃহ কাজ করে, তার পায়ে কি কোন দিন তেল দিয়েছিস? কোথাকার কোন ভন্ড দুষ্ট ঠিক নেই তাকে তুই গোসাই বলিস? সবার উদ্ধেশ্যে এবার বলেন-
তোমরাও শোন কিন্তু যতেক গোঁসাই।
তেল ঘষা ঘষি মধ্যে আমি কিন্তু নাই।। হরি ঠাকুরের পুত্র আমি বলে যাই। নারী দিয়ে তেল ঘষা এই মতে নাই।। পর নারী মাতৃজ্ঞানে সম্মান দেখাবে। কোন লোভে কোন ক্ষণে স্পর্শ না করিবে।। আমার এ কথা ছাড়া- যারা কাজ করে। তারা কিন্তু ম'তো নয় বলিনু সবারে।। শ্রীশ্রী গু.চ.পৃ: ৪৩৬/১
ঠাকুর আরো বলেন- আমার এ কথাগুলি সবার মনে রাখা চাই। সবাইকে বলি সামাল সামাল। হরি ভক্তরাও সামাল। ঠাকুরের কথা শুনে সেই নারী কেঁদে বলে- সেই ব্যক্তি যে দুষ্ট আমি তা আগে বুঝিনি বাবা। দয়াকরে এবারের মত আমায় ক্ষামা করুণ। আর আমি এমন মন্দ কাজের মধ্যে যাবনা। তার কথা শুনে ঠাকুর বলেন- না না শুধু ক্ষমা করলে হবে না। আমি যা বলি তাই যদি করতে পারিস তবে তোর ছেলেকে মরতে দেবনা। এক্ষুণি বাড়ি চলে যা। এদিক ওদিক না চেয়ে সোজা চলে গিয়ে দুই হাতে ঝাঁটা নিয়ে ওকে বেদম পেটাবি। মার খেয়ে যদি পালিয়ে যায় সেই সাথে তোর ছেলের জ্বরও পালাবে। ঠাকুরের আদেশ শোনা মাত্র সেই নারী মনে সাহস এনে বাড়ি চলে গেল। উভয় যাদবের দিকে চেয়ে ঠাকুর বল্লেন- কেমন মধুর হরিকথা শুনলে তোমরা? দু'জন কেঁদে বলেন- এমন হরিকথা কোন দিনই শুনিনি বাবা। হরি কি কি করে গেছেন তাই শুনেছি কিন্তু চোখে দেখিনি। আজ স্বচক্ষে সেটা দেখলাম। এর চেয়ে আর কি হরি কথা শোনবো।
এভাবে দিন কেটে রাত আসল। নাম গানে রাতও কাটল। পরদিন ভোরে সেই নারী এসে ঠাকুরকে প্রণাম করে কেঁদে বলল- বাবা তোমার দয়ায় আবার ফিরে এসেছি। তোমার আজ্ঞামত কাজ করেছি। সেই থেকে আমার ছেলের জ্বরও চলে গেছে। সে একদম সুস্থ। ঠাকুর তাকে বলেন- বাড়ি চলে যা। আর কোন ভয় নেই। আর যেন কোন দিন ঐ সব গোঁসাই বাড়িতে রাখিস না। হাতে হাতে ফল দেখে উভয় যাদব বিস্মত হলেন এবং ঠাকুরের করুণায় তাঁদের মন বিগলিত হল। গুরুচাঁদ যে সর্বদর্শী সেটা আরো স্পষ্ট হল।
যাদব গোস্বামী কত সালে মারা গেছেন তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়না। সেকারণে তারিখটি দিতে না পারায় দুঃখীত।
২১১
হরিভক্ত যাদব মল্লিকের জীবন কথা
হরিভক্ত যাদব চন্দ্র মল্লিক যশোর জেলার পদুমা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম চন্ডীচরণ মল্লিক। নিজের অসামান্য গুণ ও ভক্তির জোরে তিনি গুরুচাঁদের প্রিয় ভক্ত হয়েছিলেন। লোহাগাতির যাদব ঢালীর সংগে যাদব মল্লিকের বেশ সখ্যতা ছিল। দু'জন প্রায়ই একসংগে চলাফেরা করতেন- যেন হরিহর আত্মা। এবার কীভাবে যাদব মল্লিক ঠাকুরের কৃপা লাভ করেন সে কাথাই আলোচনা করছি।
ইংরেজ আমলে সাহেবরা এ দেশে নীল চাষ করতো। নীল চাষে বহু শ্রমিক দরকার হতো। এদেশে যারা প্রধান বা গণ্যমান্য ব্যক্তি ইংরেজরা তাদের মাধ্যমে মজুর (শ্রমিক) জোগাড় করতো। তাতে জোগানদাররা কমিশন পেতো। এসব সর্দাররা বিভিন্ন স্থানের নীল কুঠিতে মজুর পাঠাত। চন্ডীচরণ এরকম একজন সর্দার ছিলেন। নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে এরূপ একটা নীল কুঠি ছিল, মাসে মাসে সেখানে মজুর চালান হতো। মজুর জোগান দোবার জন্য ইংরেজ সাহেবরা অগ্রিম টাকা দিত। সর্দাররা আগ্রিম টাকা নিয়ে অর্ধেক মজুরদের দিত। এছাড়া মজুর পিছু চার আনা পেতোই। এসব চুরির ব্যাপারটা সাহেবরা জানত না। পেছন থেকে হাতি চলে গেলেও তারা চেয়ে দেখতো না। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু- এ প্রবাদটা সবারই জানা। একবার টাকা নিয়ে ভাগীদের সাথে চন্ডীচরণের বিবাদ হয়। তাতে একদিন যারা বন্ধু ছিল তারা শত্রু হয়। তারা গিয়ে টাকা চুরির কথা সাহেবকে জানায়। সাহেব শুনেতো রাগে আগুন। তারা চন্ডীচরণের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা করে দিল। এতে তাঁর জেল জরিমানা হবে ভেবে তিনি চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলেন। এই মহা বিপদে কী করবেন ভেবে পান না।
সেই সময় কালীনগরে বাস করতেন তারকচন্দ্রের গুরু সাধু মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস। পদুমা ও কালীনগর পাশাপাশি গ্রাম। চন্ডীচরণ মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে গিয়ে তার বিপদের কথা জানালেন। তখন হরিচাঁদ ঠাকুর বর্তমান। সাধু মৃত্যুঞ্জয় চন্ডীচরণকে বললেন- চল ওড়াকান্দী যাই। এই বিপদ কালে হরি বিনে বন্ধু কেউ নেই। চল দেখি দয়াময় কী বলেন। বিপদ এমনই ব্যাপার, এসময় অহংকারীর অহংকার থাকে না, মানামানও ভুলে যায়। চন্ডীচরণ চিরদিন মুতুয়াদের ঘৃণা করতেন। এখন মানামান ভুলে গেলেন। মনে তাঁর ভয় হল। না জানি হরিচাঁদ কী বলেন। উদ্বিগ্ন ও বিষাদিত মন নিয়ে শ্রীধামে উপস্থিত হলেন। কিছু জরিমানা রাখলেন ঠাকুরের পায়ের কাছে। ঠাকুর হরিচাঁদ তাঁকে বলেন- গরিবের টাকা ফাঁকী দিয়ে এনেছ, ঐ টাকা আমি নেব না। কথা শুনে চন্ডীর মনে দুঃখ হল। কেঁদে ঠাকুরের পায়ে লুটিয়ে পড়লেন। বললেন দয়াময়, আমার ভুল হয়েছে। আমার অপরাধ ক্ষমা করে এ বিপদ থেকে উদ্ধার করুণ দায়াল। ঠাকুর বলেন এই কথা বললে কি হয়? হ্যাঁ মাপ করতে পারি যারা যে টাকা পাবে তাদের সেই টাকা ফিরিয়ে দেও। তাতে যদি তারা খুশী হয় তবেই একটা উপায় হতে পারে। চন্ডী বললেন- বাবা টাকাটাতো সব খরচ হয়ে গেছে। বুঝতে পরছি এবার আমাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। শুনেছি আপনার নামে মরা বাঁচে। এ মরাকে আপনি বাঁচিয়ে নেন দয়াল। ঠাকুর বলেন- তবে যাও, কোন ভয় নেই। এ যাত্রা রক্ষা পাবে তবে ম'তো হওয়া চাই। আর একটা কাজ করতে হবে তোমাকে। সবার কাছ থেকে মাফ চেয়ে নেবে। মতুয়া ডেকে বাড়িতে হরিনাম করবে। সাধুরা মাফ করলে মোক্ষ ধাম মিলে যাবে।
২১২
ঠাকুরের আশ্চর্য লীলা বোঝে কার সাধ্য। পাপী তাপীকে উদ্ধার করার জন্যইতো ঠাকুরের আগমন। ঠাকুরের আদেশ পেয়ে চন্ডীচরণ সবকিছু করেন। কিছুদিন পর তিনি সংবাদ পেলেন সাহেব আপনা আপনি দাবী তুলে নিয়েছে। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার তাঁকে সাহেব পাঁচশত টাকা পুরস্কার দিয়েছে। এর কারণটা পরে জানা গেল। সেই বছর নীলে চাষে সাহেবের প্রচুর লাভ হয়। লাভ বেশী হওয়ায় সাহেব খুশী হয়ে চন্ডীচরণের অপরাধ মাফ করে দেয় এবং মামলা তুলে নেয়। সেই সাথে পুরস্কারও দেয়। তবে সবকিছর মূলে শ্রীহরির করুণা। অথচ আমরা এসব মানিনা, এই ভাবও বুঝি না।
সেই থেকে চন্ডীচরণ মতুয়া হন। পাপের ব্যবসা বন্ধ করেন। বাড়ির সবাই মতুয়া ভাব ধারায় চলতে থাকেন। তাঁর পুত্র যাদব ছিলেন অতীব নিষ্ঠাবান। ওড়াকান্দী বলে সব সময়ই তাঁর মন কাঁদে। যাদবের বাবা যখন বিপদে পড়ে শ্রীধামে গিয়েছিলেন যাদবও তাঁর সংগে যান এবং বাবার সংগে ঠাকুরের পায়ে পড়ে কাঁদেন। ঠাকুর তাঁকে বলেন- যাদব, তুই এই বাড়ি থেকে যা। তোর বাড়ি গিয়ে কাজ নেই। আজা পেয়ে যাদব শ্রীধামে থেকে যান।
হরিচাঁদের দেহ ত্যাগের পর যাদবকে গুরুচাঁদ খুব স্নেহ করতেন। আপন বাড়ির লোকের মত তাঁর সাথে আচরণ করতেন। কিছুকাল থেকে তিনি নিজ বাড়িতে চলে যান এবং বিবাহ করে ঠাকুরের নাম নিয়ে ঘুরে বেড়ান। তাঁর স্ত্রীর নাম বিন্দুমতি। এ সময় যাদব ঢালীর সাথে তাঁর পরিচয় হয়। দু'জন এক সংগে ঘুরে বেড়ান। নকুল গোস্বামী তাঁর কৃপা ভাজন হন। ঠাকুর ভক্তালয়ে ভ্রমণের সময় পশ্চিমাঞ্চলে গেলে পদুমায় যাদবের বাড়ি অবশ্যই যেতেন। ভক্তি গুণে তিনি ঠাকুরের কৃপা লাভ করেন এবং হরিনাম প্রচারে নিজেকে উৎসর্গ করেন। জ্ঞানী ভক্ত হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ছিল। এসব পবিত্র নিষ্ঠাবান ভক্ত দেশ ও দশের গৌরব। তাঁদের সৌরভ কোন দিন স্নান হবে না। সাধুর চরণে অভাগার শতকোটি প্রণাম।
[যাদব চন্দ্র মল্লিকের বিস্তারিত জীবন কাহিনী, সঠিক জন্ম ও মৃত্যু তারিখ পাওয়া যায়নি। সন্তান সন্ততির কথাও জানা যায়নি। আচার্য মহানন্দ হালদার ও শ্রীমৎ বিচরণ পাগল তাঁদের গ্রন্থে এ বিষয় উল্লেখ করেন নি। ফলে পাঠকদের আকাঙ্খা মেটান গেলনা।।
শ্রীমৎ রূপচাঁদ গোস্বামীর জীবন কথা
বর্তমান বাগেরহাট জেলার রামপাল থানার হুড়কা গ্রামে ১২৭২ বঙ্গাব্দে হরিভক্ত রূপচাঁদ গোস্বামী জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম রামজীবন বিশ্বাস। মাতার নাম ফুলমালা। তাঁদের গৃহ আলো করে আসে এক শিশু। পূর্ণচন্দ্র সম বালকের রূপ দেখে পিতা নাম রাখেন রূপচাঁদ। পরে অবশ্য তাঁকে সবাই রমনী বলে ডাকতো। শিশুকাল থেকে তাঁর বলিষ্ঠ গঠন ও বীরত্ব ব্যঞ্জক ভাব ছিল। সমবয়সীদের তুলনায় তিনি অধিক বলশালী ছিলেন। তাঁর চেহারার জন্য বাল্য সাথীরা তাঁকে মান্য করতেন। অল্পদিনে তিনি পঠশালায় এবং প্রথম ও দ্বিতীয়ভাগ পাঠ শেষ করেন। এরপর তাঁর পড়াশুনা আর এগোয়নি। এর পর
২১৩
তিনি কৃষিকাজ ও সাংসারিক কাজে যোগ দেন। যে কোন কাজে তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিল না। অন্যের যে কাজ করতে অনেক দিন লাগাত রূপচাঁদের করতে একদিন লাগত। তাই কৃষকরা তাঁকে ঠাট্টা করে 'নায়েব মশাই' বলে ডাকতো।
বিশ বছর বয়সে তিনি বিবাহ করেন। ডাকরা গ্রামের গোবিন্দ দাসের কন্যা ফুলমালা দেবীর সংগে তাঁর বিবাহ হয়। তিনি দুই কন্যাও এক পুত্রের জনক। কন্যার নাম চারুলতা ও নির্মলা এবং ছেলের নাম সতীশ। দিনে দিনে তিনি সংসারবদ্ধ হয়ে যান।
কবি রসরাজের কৃপালাভ:
একবার হুড়কা গ্রামে ঝলমলিয়া দীঘির পাড়ে কবিরসরাজ তারকচন্দ্র কবি গান করতে আসেন। তাঁর গান শুনে স্রোতাবৃন্দ মোহিত হয়ে যান। অশ্রুজলে তাঁদের বয়ান প্লাবিত হয়। রূপচাঁদ একটু দূরে দাড়িয়ে গান শুনছিলেন। তারককে দেখে তাঁর চিত্ত ব্যকুল হল। তাঁর মোহনীয় রূপ, মাধুর্যময় সুর, অপূর্ব কাব্য ভঙ্গীমায় তাঁর হৃদয় মুগ্ধ করে। সেই থেকে দিবানিশি তারকের রূপ চিন্তা করেন। এখানে সেখানে গেলেও মনে শান্তি পান না। এভাবে ক্রমে ক্রমে ভাদ্র মাস এল। চাষাবাদের কাজ শেষ হল। একদিন ব্রাহ্ম মুহূর্তে উঠে তিনি জয়পুর রওনা হলেন। পূর্বে তিনি কোনদিন জয়পুর যাননি। মনের মধ্যে চিন্তা শুধু তারকচন্দ্রকে। চলতে চলতে সন্ধ্যার প্রাক্কালে তারকের বাড়িতে উঠে একটি গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকেন। সিক্ত বসন, চোখে তাঁর জল। এমন সময় তারকচন্দ্র গৃহ থেকে বের হয়ে সেখানে এসে অচেনা লোককে দেখে পারিচয় জিজ্ঞাসা করেন। তিনি তাঁর পরিচয় দেন এবং মানের মানুষকে দেখে পদতলে লুটিয়ে পড়েন। রসরাজ তাঁকে উঠিয়ে আপন বক্ষে ধারণ করে ধীরে ধীরে বাড়ির মধ্যে নিয়ে আসেন। তারকের স্পর্শে তাঁর হৃদয় পুলকিত হল। চোখ দিয়ে প্রেমাশ্রু ঝরতে লাগল। দেহে যেন এক নবশক্তির
সঞ্চার হল।
কোথা থেকে কী ভাবে এসেছেন জেনে তারক তাঁকে বহু যত্ন করেন। নিজের কম্বল খানিও তাঁকে দিলেন। ঐ বাড়িতে বিশ দিন থাকার পর রূপচাঁদ বাড়ি ফিরে আসেন। রওনা কালে তারকচন্দ্র তাঁকে ঘরে গিয়ে হরিনাম করতে উপদেশ দেন। বাড়ি এসে তিনি একতারা নিয়ে গান ও হরিনাম করেন।
ভাব দেখি দেশবাসী বলে একি কান্ড।
হরি বলে সাধু হবে রূপচাঁদ ভন্ড।। শ্রীশ্রী গু.চ. পৃঃ ৪৭২/১
এসব নিন্দাবাদে কান না দিয়ে তিনি গুরুবাক্যে নিষ্ঠা নিয়ে হরি গুণাগুণ গানে মত্ত থকেন। হরি বলে তাঁর দু'নয়নে ধারা বয়। শত্রু মিত্র যার সাথে দেখা হয় সবাইকে বলেন আমাকে আশীর্বাদ করো আমি যেন হরি ভক্তি পাই। হরি বিনে আমি কিছুই চাই না। তাঁর ভাব দেখে গ্রামবাসী অনেকেই বলতে লাগলেন- রমনী (রূপচাঁদ) আর আগের মানুষ নেই। কার সংশ্রবে যেন নতুন মানুষ হয়ে এসেছে।
২১৪
দৈবযোগে তাঁর মহাজ্বর হয়। শুধু জ্বর নয়, তাঁর সাথে দেহে ক্ষতও হয়। জ্বর ও ক্ষতের জ্বালা তিনি নীরবে সহ্য করেন কিন্তু কাউকে কিছু বলেন না। কয়েক দিন পর তিনি রাতের বেলা এক শ্মশানের দিকে যান। স্বামীকে কাছে না পেয়ে তাঁর সাধ্বী সতী স্ত্রী ফুলমালা দেবী স্বামীর সন্ধানে পেছনে পেছনে যান। গিয়ে দেখেন তাঁর স্বামী তেলি ভিটা নামক স্থানে খড়ের উপর বসে একমনে গোপী যন্ত্র (একতারা) নিয়ে হরিনাম করছেন। ফুলমালা দেবী তাই দেখে সংজ্ঞা হারা হয়ে স্বামীর চরণে গিয়ে পড়েন। ভাব ভঙ্গ হওয়ায় সাধুজী দেখেন তাঁর স্ত্রী। সংজ্ঞা পেয়ে ফুলমালা দেবী কেঁদে বলেন- কোথায় যাবে তুমি আমাকে ফেলে? এসব বৈরাগ্য ভাব ছেড়ে দিয়ে ঘরে চল। ঘরে গিয়ে হরিনাম কর। সতীর বাক্যে সাধুজী ঘরে এলেন। সেই হতে তাঁর রোগ সেরে গেল।
রোগমুক্ত হয়ে রূপচাঁদ জয়পুর যান। তারককে প্রণাম করলে তারক বলেন- শোন রূপচাঁদ, পূর্ণব্রহ্ম হরিচাঁদ ওড়াকান্দী এসেছিলেন। তাঁর শক্তি এখন গুরুচাঁদের মধ্যে আছে। তুমি এখন তাঁর চরণে শরণ নেও। শুনে রূপচাঁদ বলেন-
আমার বলতে প্রভু কিছু নাহি আর।
দয়াকরে লহ মোর জীবনের ভার।। শ্রীশ্রী গু.চ. পৃ: ৪৭২/২
শুনে তারক বলেন- ঠিক আছে, তোমার ভার আমি নিলাম। এবার তুমি ওড়াকান্দী চল। তারকের সংগে সাধুজী ওড়াকন্দী যান। ঠাকুরকে প্রণাম করে তিনি কাঁদেন। ঠাকুর তাঁকে দেখেই বলেন- ও তারক, এ কোন বীরকে ধরে এনেছ? তারক সংক্ষেপে তাঁর পরিচয় দিলেন। ঠাকুর তাঁকে চারিদিকে হরিনাম প্রচার করতে বলেন। সেই থেকে তিনি ওড়াকান্দী যাতায়াত করেন। কখনও একা, কখনও তারকের সংগে যান। অধিকাংশ সময় তিনি জয়পুর তারকের বাড়িতে থাকেন। তাঁর ভক্তিগুণে তারক তাঁকে আশীর্বাদ করেন। তারকের মৃত্যুর সময়ও তিনি তাঁর কাছে ছিলেন। তারপরও বহু কাল তিনি জয়পুর ছিলেন। শোনা যায় তারকের শক্তি নাকি তিনি পেয়েছিলেন। তার ফলে রূপচাঁদ শক্তিমন্ত হন।
নায়েবের অত্যাচার নিবারণ:
বাগেরহাট শহরের বাসাবাটি এলাকার নাগ বংশীয় জমিদারদের খ্যাতি ছিল। তারা জাতিতে কায়েস্থ, বিদ্যা-বুদ্ধি ও ধনে সমৃদ্ধ। রামপাল থানার হুড়কা গ্রামে তাদের জমিদারী ছিল। হুড়কার প্রজারা আদিতে জমি বন্দোবস্ত নিয়েছিলেন। কবুলতি না দিয়ে তারা দশ স্থলে বিশ বিঘা জমি নিয়েছিলেন। বহু পরে জমিদাররা সেটা জানতে পারেন। তারা নায়েবকে হুকুম দেন সহজেই যদি প্রজারা কবুলতি না দেয় তবে জোর করে কবুলতি নিতে হবে। নায়েব এসে প্রচার করে দিলেও প্রজারা সেটা মেনে নেন না। তারা দল বেঁধে নায়েবের কাছে এসে কবুলতি দেবেনা বলে জানিয়ে দেন। এতে নায়েব খুব ক্ষিপ্ত হন এবং না না রকম ভয় ভীতি দেখান। প্রজারা ভীত হয়ে কী করা যায় সেই যুক্তি করেন। ঐ গ্রামে ডাঃ সীতানাথ মন্ডল নামে জনৈক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ধনে জনে, বিদ্যা ও বুদ্ধিতে সমাজে বিশিষ্ট স্থান দখল করেছিলেন। এলাকায় বেশ সুনাম ছিল। গুরুচাঁদের খুলনা সম্মেলনের সময় তিনি বেশ কার্যকর ভূমিকা
২১৫
পালন করেছিলেন। 'দানবীর' বলে তাঁর সুখ্যাতিও ছিল। প্রজারা সবাই একত্রিত হয়ে সীতানাথ বাবুর কাছে গেলেন। তিনি তাদের পরামর্শ দেন- এদেশে যত জামিদার আছে সবাই ইংরেজদের ভয় পায়। তাদেরই ধরতে হবে। আর একাজে গুরুচাঁদই সহায়। তাঁর সংগে ইংরেজদের ভাব আছে। তোমরা সবাই তাঁর কাছে যাও।
প্রজারা সবাই গিয়ে রূপচাঁদকে ধরেন। কারণ তিনি মতুয়া ভক্ত। গুরুচাঁদ তাঁকে স্নেহ করেন। সব কথা তাঁকে খুলে বলায় এলাকার মানুষের স্বার্থে তিনি শ্রীধাম ওড়াকান্দী যান এবং জমিদারের অত্যাচারের কথা ঠাকুরকে খুলে বলেন। সব শুনে ঠাকুর ডাঃমীডকে ডেকে সব ঘটনা জানালে মীড ঠাকুরকে আস্বস্থ করে বলেন- কোন দুশ্চিন্তা করবেন না। আমরা মিশনারী দল নিয়ে সেখানে যাব। ঠাকুর রূপচাঁদকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। এরপর ডাঃমীড তাঁদের ১২ জন মিশনারীকে খুলনা হয়ে হড়কায় পাঠান। তাঁদের আগমনে জমিদার, নায়েব ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। দেশবাসী অত্যাচার থেকে পরিত্রান পান। পরে গুরুচাঁদের পরামর্শে হুড়কায় পাঠশালা স্থাপিত হয়।
জলে ডোবা বালকের প্রাণ সঞ্চার:
হুড়কা গ্রামে অভিরাম নামে সহজ সরল এক ব্যক্তি বাস করতেন। তাঁর একটি ছোট ছেলে ছিল। ছোট হলেও সেছিল বেশ অশান্ত। একদিন দুপুরবেলায় সে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে পুকুরের জলে পড়ে মারা যায়। সেই সময় রূপচাঁদ গোস্বামী বাড়িতে বসে আরোপে গুরুরূপ চিন্তা করছিলেন। তিনি আরোপে থেকে ঘটনাটি দেখে তাড়াতাড়ি দু'জনকে নিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার বরেন। অভিরাম নিরূপায় হয়ে গোস্বামীর চরণ ধরেন এবং বলেন- দয়াকরে আমার ছেলেকে বাঁচিয়ে দিন। গোস্বামী বলেন- আমি কী ভাবে প্রাণ দেব? প্রাণদাতা একমাত্র হরিচাঁদ। মন প্রাণ দিয়ে তাঁকে ডাক। তিনিই ডোবা নাও জাগাতে পারেন। সবাই মিলে কান্নাকাটি করছে। গোস্বামীজী সবাইকে বালকের দেহ স্পর্শ করতে নিষেধ করেন এবং দূরে বসে হরিনাম করতে বলেন। তিনি নিজে মৃত বালকের কাছে যান ও হরি গুরুচাঁদ বলে বালকের বুকে চাপ দেন। দেখতে দেখতে বালকটির শরীর থেকে সব জল অপসারিত হল। অমনি বালকটি নিঃশ্বাস নিয়ে বোঁচে উঠলো। এই অদ্ভুত ঘটনা দেখে সবাই অশ্চর্যান্বিত হলেন। সবাই উচ্চ কন্ঠে হরি বলতে লাগলেন। অভিরাম ও তার ভাই অবিরাম দু'জন গিয়ে রূপচাঁদের চরণে পতিত হলেন। এই ঘটনায় হরিচাঁদের মহিমা বাড়ল। দিনে দিনে তাঁর শিষ্য সংখ্যা বাড়তে লাগল। তাঁর যশ ও সুনাম বৃদ্ধি পেতে থাকল।
বিভিন্ন জনের ব্যাধি মুক্তি:
রূপচাঁদ গোস্বামী ছিলেন শক্তিধর পুরুষ। তাঁর ভক্তিগুণে তিনি গুরুচাঁদের কৃপা লাভ করেছিলেন। তাঁর মুখের কথায় বা তাঁর স্পর্শে কতলোক যে ব্যাধিমুক্ত হয়েছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া মুশকিল। তার দুই- একটি ঘটনা বলেই শেষ করছি। যশোর জেলার মামুদপুর গ্রামের যজ্ঞেশ্বর এর 'মৃগী' রোগ হয়েছিল। রূপচাঁদের দয়ায় তিনি ব্যাধি মুক্ত হয়েছিলেন। দিগরাজ নিবাসী উচ্চ বর্ণে
২১৬
জন্য ভূপতি নামে জনৈক ব্যক্তির কঠিন ব্যাধি হয়। গোস্বামী রূপচাঁদের দয়ায় তিনি ব্যাধি মুক্ত হয়ে জাত কুলমান ত্যাগ করে তাঁকে গুরুরূপে বরণ করেছিলেন। যশোর জেলার মধ্যে শাহাবাজ পুর গ্রাম। সেই গ্রামের সৃষ্টিধর নামে জনৈক ব্যক্তির মেয়ের কঠিন রোগে মৃতপ্রায় অবস্থা। বহু ডাক্তার কবিরাজ দেখিয়েও ভাল হয় না। ফলে মৃত্যুর ঋণ শুনতে থাকে। এ সময় দৈবক্রমে গোস্বামী সেই গ্রামে যান। প্রথমে সৃষ্টিধরের তাঁর প্রতি আস্থা ছিল না। পরে মেয়ের অবস্থা দেখে সাধুজীর পায়ে পড়ে কান্নাকাটি করেন। গোস্বামী তাকে হরিনাম করতে বলেন। ঐ দিন সেখানে মহানাম সংকীর্তন হয়। প্রেমের বন্যায় সবাই ভেসে যান। কীর্তন মাঝেই কন্যাটি সুস্থ হয়ে খেতে চায়। গোস্বামী রূপচাঁদ তাকে কাঁচা লংকা ও পান্তা তাত দেন। তাই খেয়েই সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে। এরকম বহু ঘটনা রয়েছে যা তাঁর অধ্যাত্মত্ম শক্তির পরিচয় বহন করে।
গোস্বামী রূপচাঁদের মতুয়া ধর্ম প্রচারঃ
হরিনামে প্রেমে মত্ত রমনী গোঁসাই এর কাছে বিপদে পড়ে বা রোগের দায়ে দুঃখী তাপী মানুষ প্রায়ই আসেতেন। তাঁর দেয়া বিধি পালন করে তারা শাস্তি পেতেন। দিনে দিনে তাঁর নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ভক্তদের ডাকে তিনি তাদের বাড়িতে যেতেন। ভক্ত গৃহে হরিনাম সংকীর্তন ও হরিগুণগান করতেন। যেখানে যেতেন সবাইকে নিয়ে প্রেমানন্দে মেতে থাকতেন। তাঁর ভাব দেখে অনেকেই তাঁকে গুরুপদে বরণ করে মতুয়া হন।
একবার ভক্তদের আহবানে সাড়া দিয়ে তিনি খুলনার বসুরাবাদ গ্রামে যান। সেখানে গিয়ে হরিনামে মেতে ওঠেন। সেখানে এক তার্কিক ব্রাহ্মণ এসে অযথা গোস্বামী সংগে তর্ক করে হেরে যান। রুষ্ট হয়ে সে ব্রাহ্মণ কুমন্ত্রণা করে তাঁকে যন্ত্রণা দিতে চায়। হরি যাকে রক্ষা করে তাকে কে মারতে পারে? গোস্বামীকে দেখে দুষ্টের দল কিছুই করতে না পেরে সারে যায়। তিনি বিভিন্ন স্থানে গিয়ে হরিনাম প্রচার করতেন। মাটিভাঙ্গা, দেবীতলা, বয়ারভাঙ্গা প্রভৃতি স্থানে তাঁর বহু ভক্ত রয়েছে। এভাবে সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন অঞ্চল, খুলনার লবন গোলা, মোল্লারহাট থানার শিবপুর, জয়ডিহি, শিয়ালী নগরকান্দী প্রভৃতি গ্রামে তিনি হরিনাম প্রচার করেন। যশোর জেলার শূলটিয়া, গাছবাড়ি, কামারগঞ্জেও তিনি যান। সেখানে তার বহু শিষ্য আছে। ওড়াকান্দী গ্রামের কেতুরাম দাস তাঁকে গুরু হিসেবে মেনে নেন। এভাবে তিনি বহুস্থানে যান। যেখানেই যান সেখানেই বলেন-
ওড়াকান্দী হরিচাঁদ পূর্ণ অবতার।
এবে গুরুচাঁদে আছে ত্যাজি কলেবর।।
সেই পদে মানে প্রাণে লহরে শরণ। আর না আসিবে হেন মানুষ বতনা।। শ্রীশ্রী গু.চ পৃ: ৪৭৮/২
২১৭
দেহ ত্যাগঃ
বাংলা ১৩৩৮ সালের বৈশাখ মাসের বিশ তারিখ রবিবার ব্রাহ্মমুহূর্তে তিনি দেহ ত্যাগ করেন। তিনি সজ্ঞানে স্বতেজে পদ্মাসনে বসে হরিনাম করতে করতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর শিষ্যগণকে দেহ না পোড়ানোর জন্য বলে যান। তাঁর শেষ ইচ্ছামত তাঁর দেহ নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়া হয়। গোস্বামীর দেহাবসানের পর অনেক ভক্তকেই দর্শন দান করেছিলেন বলে জানা যায়। তন্মধ্যে যশোর জেলার গাওলা গ্রামের যুধিষ্ঠীর এর মা, একই জেলার গাছবাড়ি গ্রামের রামদাস ও মাধব দাসকে দর্শন দেন। তাছাড়া হাড়িখালী গ্রামের রতিকান্ত গাঙ্গুলীকেও স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন। ১৩৫০ সালের চৈত্র মাসে গোস্বামীর স্ত্রী ফুলমালা দেবীও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
কবি চূড়ামনি হরিবর সরকারের জীবন কথা
গোপালগঞ্জ জেলার মধ্যে দুর্গাপুর গ্রাম। এই গ্রামে বসবাস করেন আনন্দ সরকার। তিনি ছিলেন চারণ কবি। কবি গানে তাঁর খুব সুখ্যাতি ছিল। তাঁর স্ত্রীর নাম ময়নামতি। তিনিও সাধ্বী সতী রমনী। তাঁরা উভয়ই হরিচাঁদের ভক্ত। ক্রমে আনন্দ দম্পতির ঘরে সাতটি কন্যা সন্তান জন্মে। তাদের নাম- ত্রিপুরা, মোক্ষদা, সুখদা, সারদা, মন্দাকিনী। ৬ষ্ঠ ও ৭ম কন্যার নাম রাখার আগেই মারা যায়। কোন পুত্র সন্তান না থাকায় তাঁদের মনে খুব দুঃখ ছিল। কীভাবে বংশ রক্ষা হবে সেই দুশ্চন্তা মনের মধ্যে সব সময়ই থাকত আনন্দ সরকারের।
মনোদুঃখে একদিন তিনি সস্ত্রীক হরিচাঁদের কাছে গিয়ে মনো ব্যথা জানান। ঠাকুর তাঁদের এক বছর ব্রহ্মচর্য পালন করতে বলেন। আরো বলেন-
আমার বরেতে পুত্র জন্মিবে তোমার।
মহাকবি হবে পুত্র বরেতে আমার।। শ্রীশ্রী হ.গু.চ.সু পৃঃ ২৭৪/১
এক বছর কঠোরভাবে ব্রহ্মচর্য পালন করার পর ১২৭৫ বঙ্গাব্দের ২২ কার্তিক শুভক্ষণে এক পুত্র জন্মে। হরিচাঁদের বরে জন্ম হওয়ায় তাঁর নাম রাখা হয় হরিবর। তারপর পুত্র নিয়ে তাঁরা শ্রীধামে ঠাকুরের কাছে যান। ঠাকুর হরিবরকে আশীর্বাদ করেন।
শিক্ষালাভ:
সংসারে একমাত্র পুত্রকে পেয়ে আনন্দ দম্পতি মহা খুশী। পুত্রের শিক্ষার জন্য আনন্দ সরকার গ্রামে পাঠশালা স্থাপন করে সোখানেই প্রাথমিক পাঠ শেষ করান। এরপর ঘোনাপাড়া বিদ্যালয়ে হরিবর ছাত্র বৃত্তি পড়েন এবং যশের সাথে পাশ করেন। তখন নিয়ম ছিল ছাত্রবৃত্তি পাশ করলে মোক্তারী পড়া যেতো। তাই হরিবর মোক্তারী পড়তে যান। কিন্তু পরীক্ষা দিলেও পাশ করতে পারেননি। এরপর আনন্দ পুত্র বিয়ে দিয়ে সংসারী করেন। হরিবরের স্ত্রীর নাম সহচরী। কিছুকাল পরে তার একটি ছেলে হয়।
২১৮
দৈবের ঘটনায় পুত্র সহ পত্নী মারা যায়। এতে হরিবর শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। পিতার ইচ্ছায় তিনি আবার বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম কামিনী। শ্বশুরবাড়ি হয় বাসুড়িয়া গ্রামে। মাঝে মধ্যে তিনি বাসুড়িয়া যেতেন। এসময় হরিচাঁদ দেহ নিয়ে নেই, গুরুচাঁদ ধামেশ্বর।
একদিন হরিবর বাসুড়িয়ায় শ্বশুরবাড়িতে যান। পার্শ্ববর্তী মন্ডল বাড়িতে মতুয়ারা আসবেন এবং মহোৎসব হবে। তাই বাক্যচ্ছলে হরিবরকে বললে তিনি তাচ্ছিল্যভাবে বলেন- ওসব ঢলুয়া বৈরাগীর মহোৎসবে যাওয়া পছন্দ করিনা। তারা তাঁকে যতই বোঝান হরিবর তা শোনেন না। তাঁদের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত মহোৎসবে যান। পথে যেতে দূর থেকে মতুয়াদের কণ্ঠে সুললিত গান শুনে তাঁর মন ব্যকুল হয়ে ওঠে। কে যেন মন কেড়ে নিয়ে যায়। তারকের রচিত গানটি ছিল-
কে যাবি গৌর ঘাটে আয় চলে আয়।
শ্রীশ্রী মহাসংকীর্তন
তারকচন্দ্রের লেখা গান ভাব রসে পোরা। শুনে হরিবরের মনটা দ্রবীভূত হল। তাড়াতাড়ি তিনি মহোৎসবে এলেন। যিনি খোল বাজাচ্ছিল তার বাজনা পছন্দ না হওয়ায় তিনি নিজেই খোল বাজালেন। সকলে ভেবেছিলেন হরিবর মহোৎসবে গিয়ে কি যেন কি তর্ক বিতর্ক করে বসে কিন্তু তার কিছুই হল না। তিনি শ্বশুরালয়ে ফিরে এলেন।
পরদিন তিনি আঠঘাট বেঁধে মহোৎসবে এলেন। আজ যা হয় একটা কিছু হবে। দেখি মতুয়ারা কেমন মোহিনী মন্ত্র জানে। এমন সময় নারকেলবাড়ির মহানন্দ গোস্বামী ঐ বাড়িতে আসেন। দীর্ঘ কেশ, দীর্ঘ শ্মশ্রু, মোহনীয় কান্তি, আঁখি ছলছল, ভাবে ঢুলু ঢুলু। ভস্মে ঢাকা আগুন থেকে যেন জ্যোতি বের হচ্ছে। মুখে তাঁর মৃদু হাসি। এমন মোহনীয় কাস্তি দেখলে আপনা থেকে মন আকর্ষিত হয়। গোস্বামী মহানন্দ হরিবরের প্রতি একটুখানি করুণার দৃষ্টিতে তাকালেন। মন্ত্রমুগ্ধ সাপকে যেমন সাপুড়িয়া ধরে ঠিক তেমনি এক পলকে যেন তিনি হরিবরকে ধরেন। মুহূর্তে হরিবরের দেহ যেন অসাড় হয়ে গেল, বাক্য শক্তি রোধ হল, ঘন ঘন হাই ছাড়তে লাগলেন। বাক্যহারা হয়ে হরিবর গোস্বামী মহানন্দের পায়ে পড়লেন। কৃপাদানে তিনি হরিবরকে ধরলেন। তর্কবাদী হরিবরের তর্ক এখানেই শেষ হয়ে গেল। ভাবের ঘরে এ যেন তাঁর পুনর্জন্ম।
গৃহকর্ম ত্যাগ ও কবিগান শিক্ষা:
মহানন্দ পাগলকে দেখার পর থেকে তাঁর মন অন্য রকম হয়ে গেল। গৃহকর্ম এক রকম ছেড়েই দিলেন। মনে উদাসী ভাব। কিছুই যেন আর ভাল লাগেনা। গোস্বামীকে মনে করে চোখের জল ফেলেন। মাঝে মাঝে গোস্বামী তাঁকে দেখা দিতেন তাতে মন আরো ব্যাকুলিত হত। তাঁর উদাসী ভাব দেখে তার পিতা আনন্দ সরকার তাঁকে তিরস্কার করেন এবং গোস্বামী মহানন্দকেও গালমন্দ করেন।
২১৯
সাথে সাথে মহানন্দে গালি দেয় জোরে।
পাগল করিল কেন মোর হরিবরে।।
ছেলেধরা জুয়াচোর যত মতুয়ারা।
একেবারে করিয়াছে মোর দফাসারা।। শ্রীশ্রী গু. চ পৃ: ৪৬১/১
অলক্ষ্যে থেকে আনন্দ মতুয়াদের উদ্দেশ্যে এসব কথা বলতেন। আবার গোস্বামী মহানন্দ এলে যথোচিত ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন। হরিবর পিতার কারণে মনে খুব কষ্ট পান। এটা মহানন্দও জানতে পারেন। তাই তার দুঃখ দূর করার জন্য গোস্বামী একদিন দূর্গাপুর এসে হাজির হন।
আনন্দ সরকার গোস্বামীকে পেয়ে বহু যত্ন করে মনের দুঃখ বলেন। তিনি বলেন- মনে বড় আশা ছিল হরিবর মোক্তার হবে, ফেল করায় তা আর হলো না। এখানে সে অকর্মা অলসভাবে বাড়ী বসে থাকে। সংসারের কোন কাজে তার মন নেই, সেজন্য খুব মনোদুঃখে আছি। আপনার সংগে ঘুরুক তাতে আপত্তি নেই কিন্তু গৃহকর্মে মন দিক সেটাই চাই। শুনে গোস্বামী আনন্দকে বলেন- হরিবরের জন্য কোন চিন্তা করো না। মোক্তারীতে ফেল করেছে তাতে লজ্জা নেই। ওকে আজ আমি পাশ দিয়ে যাব। এবার সে দল করে কবিগান করবে। তোমার সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে। শুনে আনন্দ উৎফুল্ল হয়ে বলেন- এটাইতো আমি চাই। আমার দুঃখের বোঝা একটু কমাক। আপনিও হরিবরকে সেই মত বলে যান। পিতা ও গোস্বামী মহানন্দের কথা শুনে হরিবর বলেন- কবি গান করতে আমার বড় ভয়। গানে গানে শেষ পর্যন্ত না ভুলে যাই। তাই ওটা করা আমার হবে না। গোস্বামী বলেন- শোন হরিবর, আমি যা বলি সেটাই কর। কোন ভয় নেই। যেখানে যাও আমি তোমার সাথে থাকব। আমার কথা তুমি লঙ্ঘন করো না।
গোস্বামীর আজ্ঞা পেয়ে হরিবর কবিগান শিক্ষার জন্য তৎপর হলেন। প্রাথমিক শিক্ষা বাবার কাছেই হল। তারপর কবির গুরু হন কবিরসরাজ তারকচন্দ্র সরকার। তাঁর ও মহানন্দ পাগলের আশীর্বাদে কবিগানে তাঁর যথেষ্ঠ শক্তি সঞ্চারিত হল। সেইজন্য আপন জীবনে দু'জনকে হরিবর গুরু হিসাবে মান্য করেন।
একজন কবির গুরু, অন্যজন ভাবের গুরু।
মহানন্দ পাগলের সাথে তিনি ওড়াকান্দী যান। গুরুচাঁদের দর্শন পাবার পর ঠাকুর তাঁকে বলেন-
তারক তোমার গুরু শুন হরিবর।
হেন গুরু বিশ্ব মাঝে মিলিবেনা আর।।
তারকেরে দেহ মন করহ অর্পণ।
মমবাক্যে কর তাঁরে গুরুত্বে বরণ।। শ্রীশ্রী হ.গু.চ.সু পৃঃ ২৭৪/২
ঠাকুরের কথায় তিনি আরো বল পান এবং দ্বিগুণ উৎসাহের কবিগান শিক্ষা করতে থাকেন। পরবর্তীকালে কবিগানে তিনি খুব সুখ্যাতি অর্জন করেন। বিভিন্ন স্থানে কবিগান করে তিনি বহুত সম্মান পান এবং খ্যাতি অর্জন করেন। স্বয়ং গুরুচাঁদ তাঁকে রজত পদক সহ 'কবিগুণাকর' উপাধি দেন। বেতকাটা গ্রামে . কবিগান করে তিনি 'কবিরত্ন' আখ্যা পান। সুকবি রসিকলাল সরকার তাঁকে 'কবিরঞ্জন' উপাধি দেন।
২২০
নই। কারণ যে কর্ম করে সে ফল পয়, অন্যে সে ফল কীভাবে পাবে? হরিবর সাধু সংগ করলে ফলতো সে-ই পাবে তাহলে আমার উপায় কী হবে? হরিবরকে তুমি নিতে চাও নেও কিন্তু আমার উপায় কি হবে সেটা বলে যাও। আনন্দের কথা শুনে ঠাকুর সন্তুষ্ট হলেন এবং নানাভাবে শাস্ত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে আনন্দকে বোঝাবার চেষ্টা করেলেন। সবশেষে বললেন-
বংশেতে সৎপুত্র যদি জন্যে এক জন। সে বংশ উদ্ধার হয় তাহার কারণ।। শ্রীশ্রী গু.চ. পৃঃ ৫৬৫/১
তাই বলছি, তোমার সাহায্যে যদি হরিবর সাধু হয় তার ফলও তুমি পাবে। তাতে তোমার মঙ্গল হবে। তুমি হরিবরকে আর বাঁধা দিওনা। আনন্দ শুনে নীরব হলেন।
ঠাকুর সেখান থেকে শ্রীধামের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। যাবার সময় বললেন- হরিবর বাড়িতে নেই তাই আর কী বলব। সে আমার জন্য দধি পেতে রেখেছে সেটা আন দেখি। আমি তাই খেয়ে যাই। তোমরাতো 'আমার জন্য কিছুই করনি। ঠাকুর দধি খেয়ে নৌকায় উঠেলেন এবং রাউৎখামার বালা বাড়িতে এসে বিশ্রাম নিলেন। বাজার থেকে বাড়ি ফিরে হরিবর দেখেন ঠাকুর চলে গেছেন। দুঃখে তাঁর হৃদয় দহিত হল। যা কিছু কিনেছিলেন কাউকে কিছুনা জানিয়ে তাই নিয়ে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। জিজ্ঞাসায় জানতে পারেন ঠাকুর রাউৎখামার আছেন। তাড়াতাড়ি সেখানে গিয়ে দেখেন ঠাকুর ঘুমাচ্ছেন। তিনি বারান্দায় বসে গান গাইতে লাগলেন। একটা গান শেষ হলে ঠাকুর বলেন- বেশ ভাল গাইছ, আরো গাও। সারারাত ধরে গান গাও। গান বন্ধ করোনা। ঠাকুরের কথায় তিনি পরমানন্দে গান গাইতে লাগলেন। এক সময় তিনি দেখলেন এক অপূর্ব দৃশ্য। ঘরের মধ্যে একটা জানালা। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এক দ্বাদশী ললনা। সারা গায়ে তার অপরূপ আভা। দেখতে ঠিক প্রতিমার মত। ঠকুরকে সে পাখা দিয়ে বাতাস দিচ্ছে। হরিবর ভাবলেন হয়তো এবাড়ির কোন ভক্তিমতি রমনী। তাই সেদিকে আর না তাকিয়ে পুনরায় গান ধরেন। গান শেষে চেয়ে দেখেন সেখানে আরো এক নারী দাঁড়িয়ে আছে। শিরে তাঁর স্বর্ণ চূড়া বাঁধা। মনে হয় ব্রজাঙ্গনা রাধা। বারে বারে তিন বার এরকম দৃশ্য দেখে ভাবেন কে এই নারী? কেন সে দাঁড়িয়ে আছে?
এমন সময় ভোর হয়ে গেল। পূর্ব দিকে উষার আলোর পূর্বাভাষ দেখা গেল। ঠাকুর বিছানা থেকে উঠে বলেন- হরিবর এবার গান শেষ করে দরজা খুলে দেও। দরজা খুলে হরিবর দেখলেন ঘরে ঠাকুর একা, অন্যকেউ নেই। ঘরে কোন জানালাও নেই, সে নারীও নেই। ঠাকুর একা খাটের উপর বসে আছেন। হতজ্ঞান হরিবর মনে মনে ভাবলেন- নারীর হাতে ঠাকুরকেতো কখনও সেবা নিতে দেখিনি। নিশ্চই এই নারী সামান্য মানুষ নন। দেবের দেবতা হলেন গুরুচাঁদ। সেজন্যই বোধহয় দেব দেবীরা এসে তাঁর পূজা করেন। এসব ভেবে তিনি কাঁদতে লাগলেন। অন্তর্যামী ঠাকুর গুরুচাঁদ বললেন- শোন হরিবর, ভাগ্যগুণে কেউ কিছু দেখলে জ্ঞানীরা তা প্রকাশ করে না। শীঘ্র বাড়ি যাও। যা দেখেছ তা তোমার ভগ্যগুণে, কাউকে বলো না। মনের মধ্যে বিভিন্ন চিন্তা করতে করতে হরিবর গৃহে ফিরলেন।
২২২
গুরুচাঁদের কৃপায় কঠিন ব্যাধি মুক্তি:
একবার হরিবর তারকের সাথে খুলনা জেলার হালিশহর গ্রামে যান। সংগে যাদব মল্লিকও ছিলেন। দৈবে হটাৎ এক সন্ধ্যায় তাঁর দারুণ বেদনা হয়। অসহ্য বেদনায় ছটফট করতে থাকেন। ক্ষণে ক্ষণে তারকচন্দ্রের পা ধরে কাঁদেন। কিন্তু তারক কোন কথা বলেন না। ব্যথায় সারারাত কষ্ট পান। সকালে সামান্য উপশম হয়। যাদব কেঁদে তরকের পা ধরে হরিবরের ব্যাধি মুক্তির কথা বলেন। তারকচন্দ্র বলেন- এ ব্যাধি সারাবার নয়। তবে হরিবর যদি এক কাজ করতে পারে তবে তাঁর ব্যথা সেরে যাবে। সেটা হল- তাঁকে মহানন্দ পাগলকে ভুলে যেতে হবে। তা'হলে এ রোগ আর হবে না। হরিবর কী সেটা পারবে? আমার মনে হয় সেটা তার পক্ষে অসম্ভব। মহানন্দের অদর্শনে এই রোগ হয়েছে তার। শুনে হরিবর বলেন- আমি মরে গেলেও সেটা করতে পারব না। এভাবে দিন যায় কিন্তু রোগ সারেনা। গানের বায়নাও কয়েকটা খেলাপ হল।
একদিন অসহ্য বেদনা উঠলো। গুরুচাঁদের কাছে লোক পাঠান হল। ঠাকুর যে বিধান দিলেন তাতে একদিন ব্যথা সামান্য কমে পরদিন ব্যথা দ্বিগুণ হল। আবার ঠাকুরের কাছে লোক পাঠান হল। ঠাকুর বলেন- আর কোন বিধান জানিনা। এতে সারুক মরুক যা হয় হবে। দিনে দিনে তাঁর রোগ বেড়েই চলল। দেহ জীর্ণশীর্ণ হলো। মনে হয় বেশীদিন বাঁচবে না। এ সময় দুই জন মতুয়া ভক্ত দুর্গাপুর আসেন। তারা শ্রীধামে যাবেন। তিনি তাঁদের বলে দিলেন তাঁর রোগের কথা যেন ঠাকুরকে না বলেন। তাঁরা ওড়াকান্দী উপস্থিত হলেন কিন্তু কিছুই বলেন না। দুই দিন পর তৃতীয় দিনে তাঁরা ঠাকুরের কাছে বিদায় নিতে গেলে ঠাকুর বলেন- তোমরা দু'জন এক সাথে দুর্গাপুর যাও। হরিবর দারুণ ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে। কষ্ট পেলেও আমাকে কিছু বলেনা। তাকে গিয়ে বল- আজ হতে রোগ দূরে যাবে। আমার জানতে কিছু বাকী নেই। তাকে বলো তার ব্যথা চলে যাবে, তার মরা হবে না। এতক্ষণ যে কথাটি শোনার জন্য তাঁরা ইতস্তত: করছিলেন এবার তা শুনে তারা ঠাকুরের পায়ে লুটিয়ে পড়লেন।
ঠাকুরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তাঁরা দুর্গাপুর এলেন। এসে দেখেন হরিবর হেঁটে বেড়াচ্ছেন। রোগের কোন চিহ্নই তাঁর শরীরে নেই। প্রেমে পুলকিত হয়ে তারা বলেন- তোমার রোগ সেরে গিয়েছে তো? উত্তরে হরিবর বলেন- ভাই অদ্ভুত ঘটনা। আজ হতে আমার বেদনা একদম সেরে গেছে। আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। তখন তাঁরা সব ঘটনা খুলে বলেন। তাঁদের মুখে শুনে তিনি চোখের জলে ভাসলেন। ওহোরে দয়াল বলে ধূলায় গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। কান্না যেন আর থামেনা। যারা কাছে ছিলেন তাঁরা তাঁকে ধরে উঠালেন। প্রেমানন্দে সারা রাত কাটালেন। প্রভাতে সেই দুই ব্যক্তি বিদায় নিলেন। সেই থেকে হরিবর চিরতরে রোগ থেকে মুক্তি পেলেন।
হরিবরের প্রতি গুরুচাঁদের কৃপা:
মহাবারুণীর সময় দল নিয়ে ভক্তরা প্রতিবছর দুর্গাপুর আসতেন। তাঁদের সেবা ও আহারাদির ব্যবস্থা হরিবর নিজেই করতেন। একবার তাঁর সংসারে খুব অভাব দেখা দেয়। ঘরে মাত্র সাত পৈকা ধান ছিল। এ দিয়ে ভক্তসেবা হবেনা। তাই মনে খুব দুঃখ। বারুণীর পূর্বে একদিন শ্রীধামে গিয়ে কেঁদে
২২৩
কেঁদে ঠাকুরকে জানান- বাবা, ঘরে মাত্র সাত পৈকা ধান আছে। এদিকে বারুণী নিকট। বহু ভক্ত দুর্গাপুর আসবেন। তাঁদের সেবা কী ভাবে করবো সেজন্য মনে বড়ই দুশ্চিন্তা। ঠাকুর বলেন- তুমি চিন্তা করোনা হরিবর। এবার তুমি আর খেতে দিওনা। হরিবর বলেন- সেটা কেমন হবে বাবা? মতুয়াদের খেতে না দিলেতো হবেনা। আপনি একটু কৃপাদৃষ্টি করলে যত ভক্তই আসুক তাতে কোন অসুবিধা হবে না। ঠাকুর বলেন- শোন তোমাকে একটা ঘটনার কথা বলি। একবার তারকের খুব অভাব হয়। তাই কেঁদে কেঁদে বাবার কাছে জানালে বাবা তাঁকে বলেন, কুমড়া আর মাছ খেলে আমি বড় আনন্দ পাই। অন্য কোন কথা না বলে কুমড়া ও মাছের কথা ঠাকুর কেন বললেন? নিশ্চই এতে কোন উদ্দেশ্য আছে ঠাকুরের। তারকচন্দ্র বাড়ি গিয়ে হাতে টাকা না থাকায় একটি ঘটি বন্দক রেখে সেই টাকা দিয়ে কুমড়া ও কিছু মাছ কিনে নিয়ে বাবাকে দিলেন। বাবা তাঁকে বলেন, কোন ভয় নেই তারক। এবার ঘরে চলে যাও। যত ধান আছে তাই বছর ধরে খেও। বাবার কৃপায় দেখ কী ফল হল। বছর ধরে সেই ধান্য খেল, যে ধান সেই ধানই রয়ে গেল। লক্ষ্মী যাঁরে পূজা করে সেই যদি বলে চঞ্চলা অচলা হয়ে সেই ঘরে থাকে।
ঠাকুরের কথা শুনে হরিবর কেঁদে আকুল। তিনি বুঝতে পারলেন ঠাকুর প্রকারন্তরে কী বলতে চাইছেন। দৈবযোগে তিনি বাড়ি থেকে একটি ঘটি এনেছিলেন। সেই ঘটি বন্ধক রেখে চার আনা পেলেন। দু'পয়সা দিয়ে কুমড়া কিনলেন। কিন্তু মাছ জোগাড় করতেনা পেরে সেই অর্থ ঠাকুরের কাছে দিলেন। ঠাকুর বললেন- আর কোন ভয় নেই হরিবর। এবার বাড়ি যাও। বাড়ি এসে ধান মেপে দেখেন সাত পৈকার স্থলে উনিশ পৈকা হয়েছে। শ্রীধাম থেকে আসার পর বার পৈকা ধান বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দেখে প্রেমেতে আপ্লুত হয়ে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন।
এই সময় পারশলুয়া গ্রাম থেকে হরিবর নামে তাঁর এক শিষ্য এসে হাজির। তিনি এসে বলেন- বাবা, এবার মহোৎসবে আমি দু'ইমন চাল দিতে চাই। আপনি আজ্ঞা করলে তাই এনে দেই। শুনে হরিবর কেঁদে আত্মহারা। ঠাকুরের কী দয়া। তাঁর দয়ার তুলনা নেই। এমন দয়াল বান্ধব আর কোথায় গিয়ে পাব? সে বছর মহানন্দে হরিবরের বাড়িতে মহোৎসব সম্পন্ন হয়। কোন কিছুতে অভাব না হয়ে উদ্ধৃত্তই ছিল।
রচনা কর্ম:
হরিবর সরকার কবিগান করতেন সেটা আমরা পূর্বে জেনেছি। তাঁর নিয়ম ছিল প্রতিপালা গানে যত টাকা বায়না হতো টাকা প্রতি এক পাই ঠাকুরের জন্য রেখে দিতেন। প্রতিবছর এই খাতে বিশ/ত্রিশ টাকা হত। এই অর্থ তিনি ঠাকুরকে দিতেন। গঙ্গাচর্ণাবাসী অশ্বিনী গোঁসাই এর পিতা কার্তিক বৈরাগী খুব দরিদ্র ছিলেন। তারকের আদেশে হরিবর তাকে অর্থ সাহায্য করতেন।
হরিবর ছিলেন স্বভাব কবি। কবিগান ছাড়াও তিনি মতুয়া সংগীত রচনায় সিদ্ধ হস্ত ছিলেন। তিনি কয়েকটি গ্রন্থও রচনা করেন। একবার আমবাড়িয়া নিবাসী নীলরতন নামে জনৈক ভক্ত হরিবরকে বলেন- বাবা গুরুচাঁদ কথা প্রসংগে বলেছেন আজ যদি কোন লেখক থাকত তবে-
২২৪
কেঁদে ঠাকুরকে জানান- বাবা, ঘরে মাত্র সাত পৈকা ধান আছে। এদিকে বারুণী নিকট। বহু ভক্ত দুর্গাপুর আসবেন। তাঁদের সেবা কী ভাবে করবো সেজন্য মনে বড়ই দুশ্চিন্তা। ঠাকুর বলেন- তুমি চিন্তা করোনা হরিবর। এবার তুমি আর খেতে দিওনা। হরিবর বলেন- সেটা কেমন হবে বাবা? মতুয়াদের খেতে না দিলেতো হবেনা। আপনি একটু কৃপাদৃষ্টি করলে যত ভক্তই আসুক তাতে কোন অসুবিধা হবে না। ঠাকুর বলেন- শোন তোমাকে একটা ঘটনার কথা বলি। একবার তারকের খুব অভাব হয়। তাই কেঁদে কেঁদে বাবার কাছে জানালে বাবা তাঁকে বলেন, কুমড়া আর মাছ খেলে আমি বড় আনন্দ পাই। অন্য কোন কথা না বলে কুমড়া ও মাছের কথা ঠাকুর কেন বললেন? নিশ্চই এতে কোন উদ্দেশ্য আছে ঠাকুরের। তারকচন্দ্র বাড়ি গিয়ে হাতে টাকা না থাকায় একটি ঘটি বন্দক রেখে সেই টাকা দিয়ে কুমড়া ও কিছু মাছ কিনে নিয়ে বাবাকে দিলেন। বাবা তাঁকে বলেন, কোন ভয় নেই তারক। এবার ঘরে চলে যাও। যত ধান আছে তাই বছর ধরে খেও। বাবার কৃপায় দেখ কী ফল হল। বছর ধরে সেই ধান্য খেল, যে ধান সেই ধানই রয়ে গেল। লক্ষ্মী যাঁরে পূজা করে সেই যদি বলে চঞ্চলা অচলা হয়ে সেই ঘরে থাকে।
ঠাকুরের কথা শুনে হরিবর কেঁদে আকুল। তিনি বুঝতে পারলেন ঠাকুর প্রকারন্তরে কী বলতে চাইছেন। দৈবযোগে তিনি বাড়ি থেকে একটি ঘটি এনেছিলেন। সেই ঘটি বন্ধক রেখে চার আনা পেলেন। দু'পয়সা দিয়ে কুমড়া কিনলেন। কিন্তু মাছ জোগাড় করতেনা পেরে সেই অর্থ ঠাকুরের কাছে দিলেন। ঠাকুর বললেন- আর কোন ভয় নেই হরিবর। এবার বাড়ি যাও। বাড়ি এসে ধান মেপে দেখেন সাত পৈকার স্থলে উনিশ পৈকা হয়েছে। শ্রীধাম থেকে আসার পর বার পৈকা ধান বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দেখে প্রেমেতে আপ্লুত হয়ে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন।
এই সময় পারশলুয়া গ্রাম থেকে হরিবর নামে তাঁর এক শিষ্য এসে হাজির। তিনি এসে বলেন- বাবা, এবার মহোৎসবে আমি দু'ইমন চাল দিতে চাই। আপনি আজ্ঞা করলে তাই এনে দেই। শুনে হরিবর কেঁদে আত্মহারা। ঠাকুরের কী দয়া। তাঁর দয়ার তুলনা নেই। এমন দয়াল বান্ধব আর কোথায় গিয়ে পাব? সে বছর মহানন্দে হরিবরের বাড়িতে মহোৎসব সম্পন্ন হয়। কোন কিছুতে অভাব না হয়ে উদ্ধৃত্তই ছিল।
রচনা কর্ম:
হরিবর সরকার কবিগান করতেন সেটা আমরা পূর্বে জেনেছি। তাঁর নিয়ম ছিল প্রতিপালা গানে যত টাকা বায়না হতো টাকা প্রতি এক পাই ঠাকুরের জন্য রেখে দিতেন। প্রতিবছর এই খাতে বিশ/ত্রিশ টাকা হত। এই অর্থ তিনি ঠাকুরকে দিতেন। গঙ্গাচর্ণাবাসী অশ্বিনী গোঁসাই এর পিতা কার্তিক বৈরাগী খুব দরিদ্র ছিলেন। তারকের আদেশে হরিবর তাকে অর্থ সাহায্য করতেন।
হরিবর ছিলেন স্বভাব কবি। কবিগান ছাড়াও তিনি মতুয়া সংগীত রচনায় সিদ্ধ হস্ত ছিলেন। তিনি কয়েকটি গ্রন্থও রচনা করেন। একবার আমবাড়িয়া নিবাসী নীলরতন নামে জনৈক ভক্ত হরিবরকে বলেন- বাবা গুরুচাঁদ কথা প্রসংগে বলেছেন আজ যদি কোন লেখক থাকত তবে-
২২৪