সাইটটি নির্মাণাধীন রয়েছে, ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
২। দ্বিতীয় শ্রীপাট: জয়পুর
শ্রীপাট কর্তা: শ্রীমৎ তারকচন্দ্র সরকার
অবস্থান: গ্রাম: জয়পুর, পোস্ট: লোহাগড়া বাজার, উপজেলা: লোহাগড়া, জেলা: নড়াইল
শিক্ষা জীবন:
বংশের একমাত্র সন্তান বলে পিতা মাতা ছাড়াও পিতৃব্যদের কাছ থেকে অধিক স্নেহ লাভ করতেন। কাশিনাথ খুব গরিব ছিলেন। চাষযোগ্য জমি তেমন ছিল না। কবিগান করাই ছিল তাঁর জীবিকার একমাত্র উৎস। আর্থিক কারণে পুত্রকে তেমন লেখাপড়া করাতে পারেননি। বিদ্যালয়ে যাবার বয়স হতেই তাঁর পিতা তাঁকে ছাতড়ার গ্রামে পাঠশালায় ভর্তি করে দেন। তারক চন্দ্র ছিলেন অসাধারণ শ্রুতিধর। একবার কিছু শুনলে বা পড়লে তাঁর সবই মনে থাকত। জানা যায় তাঁর এক দিনেই সমস্ত বর্ণমালা শেখা হয়ে যায়। দ্বিতীয় দিনে সংযুক্ত বর্ণমালা শেখা হয় এবং সাত দিনের মধ্যে তাঁর দ্বিতীয় মানের বই পড়া শেষ হয়েছিল। এভাবে তিনি ছয় মাসের মধ্যে ছাত্র- বৃত্তি পড়া শেষ করেছিলেন।
তারক চন্দ্রের পিতা একজন কবিয়াল ছিলেন। তিনি সব সময় নানা শাস্ত্র গ্রন্থ পাঠ করতেন। তা দেখে ঐ বয়সেই তারক চন্দ্রের শাস্ত্রগ্রন্থ পড়ার প্রতি আগ্রহ জন্মে। বাড়িতে যখন কবির মহড়া হত তিনি সেখানে বসে সব দেখতেন ও শিখতেন। তিনি অল্প বয়সেই গীতা, ভাগবত, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি শান্তগ্রস্থগুলি পড়ে আয়ত্ব করেন। মাঝে মাঝে পিতার সংগে তিনি কবিগানের আসরে যেতেন। তাই কবিগানের প্রতি তাঁর একটা আকর্ষণ ছিল। ভবিষ্যতে তিনি কবিগান শিখবেন এই আশাও করতেন। কিন্তু আশাপূর্ণ হওয়ার আগেই ১৮৫৯ সালে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। সেসময় তারক চন্দ্রের বয়স মাত্র পনের বৎসর। পরিণত বয়সে তিনি বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম চিন্তামনি।
কবিগানের দল গঠন:
পিতার মৃত্যুর পর তারক চন্দ্র চোখে যেন অন্ধকার দেখলেন। পিতার কবির দল ভেঙ্গে গেল। আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেল। এই অসহায় অবস্থায় কী ভাবে যে সংসার চালাবেন এই চিন্তা তাঁকে ব্যাকুল করে তুললো। পিতৃ পেশা কবিগান গাওয়া তাঁর পক্ষে দুঃসাধ্য। অবশেষে কিছু টাকা সংগ্রহ করে ব্যবসা শুরু করলেন। কিন্তু তাতেও তেমন সুবিধা হল না। এর পর তিনি পিতার দোহারদের সংগ্রহ করে কবিগানের দল গঠন করেন।
পিতার কাছেই তারক চন্দ্রের কবিগানের হাতেখড়ি হলেও ভালভাবে কবিগান শেখা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে পিতার দোহারগণ যথেষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। তাঁর পিতা যেসব জায়গায় কবিগান করতেন দোহারগণ সেখানে গিয়ে কর্মকর্তাদের বুঝিয়ে বায়না ধরতে লাগলেন। কেননা সম্পূর্ণ নতুন ও অল্প বয়সী কবিয়ালের পক্ষে বায়না পাওয়া সহজ ছিলনা। তিনি ছিলেন যথেষ্ঠ আত্মপ্রত্যয়ী। তাই কয়েক বছরের মধ্যে তিনি কবিয়াল রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। কিন্তু তাঁর কণ্ঠস্বর খারাপ থাকায় আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করা যায়নি। কবিগানে গান একটা বিশেষ অঙ্গ। গলার স্বরের জন্য তিনি সব সময় দুঃখ অনুভব করতেন। পরবর্তীকালে হরিচাঁদ ঠাকুরের আশীর্বাদে তাঁর স্বর খুব মিষ্টি ও শ্রুতি মধুর হয়েছিল। সে প্রসংগে পরে আসছি।
একবার কবিরসরাজ তারক চন্দ্র সরকার যশোর জেলার কালিয়া নামক গ্রামে করিগান করছিলেন। সেখানে বহু শিক্ষিত ও পন্ডিত লোকের বাস। সেই সমাজে কবিগান গেয়ে সুনাম অর্জন করাটা খুবই কষ্ট সাধ্য ব্যাপার হলেও তারকের কবিগান শুনে সবাই উচ্চ প্রশংসা করেন। সেই পালের আসরে মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস নামে হরিচাঁদের এক বিশিষ্ট ভক্ত তাঁর গান শোনার জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন। এখানে প্রসঙ্গক্রমে মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের একটু পরিচয় দেয়া আবশ্যক। কারণ তাঁর জন্য তারকচন্দ্রের জীবনের মোড় ঘুরে যায়। তাঁর বাড়ি ছিল গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী থানার মল্লকাব্দী গ্রামে। পরবর্তী কালে তিনি যশোর জেলার কালীনগরে বসবাস করেন। তাঁর পিতার নাম নিত্যানন্দ বিশ্বাস এবং মাতার নাম সুভদ্রা দেবী। তাঁর পরিবারস্থ সবাই নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব ছিলেন। মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস সাধন মার্গের উচ্চ শিখরে উঠে অধ্যাত্য শক্তির অধিকারী হয়েছিলেন। তিনি ভাল শাস্ত্রজ্ঞও ছিলেন। শোনা যায় তিনি কিছুদিন কবিগান গেয়েছিলেন। পরবর্তী কালে তিনি মতুয়া ধর্মের প্রবর্তক হরিচাঁদ ঠাকুরের একনিষ্ঠ ভঙ হয়েছিলেন।
কালিয়া গ্রামে কবিগানের আসরে উপস্থিত হওয়ার সংগে সংগে মৃত্যুঞ্জয় এর প্রতি তারকের মন নিবিষ্ট হয়। এতে কবিগান ব্যহত হচ্ছিল। স্রোতারাও বিরক্ত হচ্ছিল। এটা বুঝতে পেরে মৃত্যুঞ্জয় তারক চন্দ্রকে ইঙ্গিতে তাঁর সংগে দেখা করতে বলে আসর ছেড়ে অন্য এক বাড়িতে চলে যান। ঐ আসরে তারকচন্দ্র ভগবানের রূপের এমন সুন্দর বর্ণনা দিচ্ছিলেন যে তা শুনে সমস্ত স্রোতারা মুগ্ধ হয়ে তাঁর প্রশংসা করেছিলেন। গান শেষে তারক মৃত্যুঞ্জয়ের সংগে দেখা করেন। তাঁকে পেয়ে মৃত্যুঞ্জয় মহাখুনী হয়ে বললেন- তুমি গানের আসরে ভগবানের রূপের যে বর্ণনা দিয়েছ, ভগবানকে তমি সেরূপে দেখেছ নাকি? তারক বিস্ময়ে হেসে বলেছিলেন- তা কি করে সম্ভব? ভগবানকে দেখা যায় নাকি? মৃত্যুঞ্জয় পুনরায় বলেন- না দেখে ঐ রূপের বর্ণনা দেয়া যায় না। তবে তুমি যদি দেখতে চাও তবে তোমাকে মানুষরূপী ভগবানকে দেখাতে পারি। তিনিও সেই রূপের অধিকারী। তুমি একবার আমার বাড়িতে যেও। এই বলে তিনি নিজ গৃহে চলে েেগলেন।
সাধু মৃত্যুঞ্জয় এর কৃপালাভ:
এরপর কিছুদিন অতিবাহিত হল। মৃত্যুঞ্জয়ের কথা মনে এলেও যাওয়া যাওয়া করেও যাওয়া হয় না। একদিন তাঁর দোহার সূর্য নারায়ণকে কালীনগর যাওয়ার কথা বলেন। তিনিও তাঁকে মৃত্যুঞ্জয় সম্পর্কে অনেক কথা বলেন। তাতে তারকের মন আরো আকৃষ্ট হয়। সেখানে যাবার জন্য মন ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সূর্যনারয়নকে বলেন-
মোর মনে এই কয় মৃত্যুঞ্জয়ী মৃত্যুঞ্জয়
নবরূপে করিতেছে খেলা।
আমার পাগল মন করিতেছে আকর্ষণ
শোনামাত্র প্রাণে হল জ্বালা।। শ্রীশ্রী গু.চ.পৃ: ২৮৮/২
তার মন চলে গেছে, শুধু দেহ পড়ে আছে। শূন্যবুকে ব্যকুলতা নিয়ে ঘন ঘন হাই ছাড়েন। রাতে আবার মহামায়া স্বপ্নে তাঁকে দেখা দিয়ে বলেন- শোন তারক, লক্ষ্মীপাশা কালীমন্দিরে আমি অধিষ্ঠিত আছি। তোমার বাবা কালীভক্ত ছিলেন। তার বুক চিরে আমায় রক্ত দিয়েছিল। সেজন্য তোমার মঙ্গল হোক সেটা আমি সব সবসময়ই চাই। তোমাকে বলছি-তুমি সাবু মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে যাও। তিনি মহা শক্তিধারী পুরুষ। সেখানে গেলে তোমার মনোবাঞ্ছা পূরণ হবে। এই বলে মহামায়া অন্তর্ধান হলেন।
নিদ্রাভঙ্গের পর সকালে তারকচন্দ্র সূর্যনারায়ণকে নিয়ে কালীনগরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। প্রথমে নবগঙ্গা পার হয়ে লক্ষ্মীপাশা কালীমন্দিরে গিয়ে প্রণাম করে পথ চলতে শুরু করলেন। বেলাশেষে তাঁরা কালীনগর মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়ি উপস্থিত হলেন। তাঁদের দেখে সাধু মৃত্যুঞ্জয় গৃহমধ্যে প্রবেশ করে যোগাসনে বসে পড়লেন। তারক ভিতরে ঢুকে দেখেন দু'টি আসন পাতা। একটিতে মৃত্যুঞ্জয় বসে ধ্যানমগ্ন ঋষির মত বসে আছেন। অন্যটি শূণ্য। তারককে সেটিতে বসতে ইঙ্গিত করলেন। তারক সেটিতে বসে তাঁর দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে রইলেন। এভাবে রাত কেটে গেল। সকালে তিনি তারককে উঠে যেতে বললেন। তারক উঠে গেলেও মৃত্যুঞ্জয় একই আসনে বসে রইলেন। তারকের কথায় সূর্যনারায়ণ বাড়ি চলে যান। সন্ধ্যায় তারক আবার সেখানে যান সাধু মৃত্যুঞ্জয়ের ইঙ্গিতে বসে পড়েন। ভোরে আবার চলে যান। এভাবে তিনদিন তিন রাত কেটে যায়। মৃত্যুঞ্জয় একই আসনে এক ভাবেই বসে থাকেন। গভীর রাতে তারক সচক্ষে দেখেন জ্যেতির্ময় মূর্তিধারী বহু নরনারী এসে মৃত্যুঞ্জয়কে ঘিরে 'ওঁ গুরবে নম' বলে প্রণাম করছে। তিনি তাঁদের হাত তুলে আশীর্বাদ করছেন। মুহূর্ত মাত্র থেকে তারা চলে গেলেন। এ দৃশ্য দেখে তারকচন্দ্র যেন হত জ্ঞান। মনের মধ্যে নানা প্রশ্নের উদয় হল। সকালবেলা সূর্য ওঠার পর সাধু মৃত্যুঞ্জয় বাইরে এলেন। জ্ঞান হারা প্রায় তারক ধূলায় পড়ে কাঁদতে লাগলেন। মৃত্যুঞ্জয় তাঁকে ধরে তুললেন এবং বললেন- তারক রে আজ তুই আমার কেনা হয়ে গেলি। তোর বাসনা পূরণ হবে, কোন ভয় নেই। এবার বল দেখি কিজন্য এসেছিস? তারক কেঁদে বলেন-আজ থেকে আপনি আমার গুরু। দয়াকরে চরণ ছাড়া করবেন না। মৃত্যুঞ্জয় বললেন, যাও বাড়ি যাও। পুনরায় আবার এসো। ক্রমে সব কিছু জানতে পরবে।
হরিচাঁদের দর্শন ও কৃপালাভ:
কিছুদিন কেটে গেল। তারকচন্দ্র মাঝে মাঝে কালিনগর আসেন আবার বাড়ি যান। একদিন এসে দেখেন গুরু মৃত্যুঞ্জয় নিজ আসনে বসে আছেন। তারক গিয়ে প্রণাম করতেই বললেন-জান কি তারক, ওড়াকান্দী হরি অবতার এসেছেন? আমাকে ঘিরে যা কিছু আছে সবই তাঁর কৃপা ছায়া। যদি জনম সফল করতে চাও তবে সময় থাকতে ওড়াকান্দী যাও। তুমি বললে আমি তোমার সাথে যেতে পারি। হরিচাঁদ অবতার এসেছেন শুনে তারকের মনে সন্দেহ দোলা দিল। গুরু কী বলেন? গৌরাঙ্গের পরতো আর কোন অবতার নেই। তবে কেন তিনি একথা বলছেন। তারক এসব প্রশ্ন করতেই মৃত্যুঞ্জয় বললেন-তারকরে সন্দেহ করা ঠিক না। শ্রীজীব গোস্বামীকৃত 'চৈতন্য ভাগবত' এর সন্ন্যাস অধ্যায়টা পড়ে দেখ। সেখানে লেখা আছে চৈতন্য মহাপ্রভু মাতাকে বলেছিলেন তাঁর গর্ভে আরো দুইবার জন্ম নেবেন।
তব গর্ভে জন্ম নেব আরো দুইবার।
এই নহে মাতা মোর শেষ অবতার।
শ্রীশ্রী ৫.চ.পৃ: ২৯০/২
বাড়ি গিয়ে পড়ে দেখগে। তোমার সন্দেহ দূর হয়ে যাবে।
তারক চন্দ্র বাড়ি গিয়ে চৈতন্য ভাগবত সংগ্রহ করে পড়ে দেখেন গুরুদেব যা বলেছেন স্টোং ঠিক। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু শেষ অবতার নন। তার মনে তবুও সন্দেহ যায় না। ভাবলেন-অবতার হলেছে অঙ্গে দ্বাত্রিংশ লক্ষণ থাকবে। তা কি হরিচাদের আছে? তিনি মহৎ পুরুষ হতে পারেন, হতে পারেন শক্তিশালী সাধক পুরুষ। তিনি আরো ভাবলেন-তাঁর গুরুর শুরু হরিচাদ সেহেতু তাঁকে তিনি ভগবন ভাবতে পারেন কিন্তু আমার ভগবান হলেন গুরু মৃত্যুঞ্জয়। কাজ নেই আমার ওড়াকান্দী হরিচাদরে দেখে। মৃত্যুঞ্জয়ই আমার সব। তিনি সদয় হলে আমার সব হবে।
আবারও কয়েক দিন কেটে গেল। একদিন তিনি কালীনগর গেলে মৃত্যুঞ্জয় হেসে বলেন- তরক এখনো তোমার মনের সন্দেহ? আমার কথা শোন। দূর থেকে যা কল্পনা করনা কেন সবই অলীর। ওড়াকান্দী গেলে সব ঠিক হবে।
সন্দেহ ভঞ্জন হরি আছে ওড়াকান্দী।
চল এক সংগে মোরা সেই পদ বন্দী।। শ্রীশ্রী গু.চ.পৃঃ-২৯১/১
তারকচন্দ্র স্বীকার করলেন এবং দুই দিন পর শুভ যাত্রা করলেন। অন্তর্যামী হরিচাঁদ সবই জানলেন। সন্দেহের দোলায় দুলে মৃত্যুঞ্জয়ের সংগে তারক চন্দ্র ওড়াকান্দী এলেন। শ্রীধামের পবিত্র মাটি স্পর্ণ করার সংগে সংগে তারকের মন অন্যরকম হয়ে গেল। ঠাকুর চটকাতলায় ছিন্ন কাঁথা গায় দিয়ে বসে আছেন। দু'জন আসার সাথে সাথে ঠাকুর বললেন-ওরে গোলক, ওরে হীরে, তোরা দেখে যা, মিতুনে এক তোতাপাখীর ছা এনেছে। মৃত্যুঞ্জয় এসে মহাপ্রভু হরিচাঁদকে যাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন। চোখে তাঁর প্রেমাশ্রু। ভাবে গদ গদ। তারক এক দৃষ্টে ঠাকুরের প্রতি চেয়ে আছেন। প্রণাম করতে যখন ভূমি স্পর্শ করলেন সন্দেহ ভঞ্জন হরিচাঁদ তাঁকে সমস্ত লক্ষণগুলি দয়া করে দেখালেন-
দুইপদ প্রসারিয়া প্রভু দেখাইল। ধ্বজ বজ্রাঙ্কুশ চিহ্ন তারক দেখিল।। ঊর্দ্ধ দৃষ্টি করি তবে চাহিল তরক। ঊর্দ্ধ হস্ত করিলেন ভূবন পালক।। সমভাবে অলসতা নাসিবার তরে। মহাপ্রভু হস্তপদ প্রসারিত করে।। শ্রীশ্রী গু.চ.পৃঃ ২৯১/২
তারকচন্দ্র ঠাকুরের দেহে দ্বাত্রিংশ লক্ষণ দেখে অবিভূত হলেন। তাঁর মনে যে সন্দেহের মেষ ছিল হরি- কৃণা-বায়ুতে তা দূর হয়ে গেল। জান হারা তারক মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। হঠাৎ তাঁর মাথাটি ঠাকুর পাদিয়ে স্পর্শ করলেন। সংগে সংগে তারকের দেহে শক্তি সঞ্চারিত হল। দেহ পুলকিত হল। সর্বাঙ্গে যেন এক শিহরণের ঢেউ আছড়ে পড়ল। তিনি সংজ্ঞাহারা হলেমারিককুরবানদের জিয় ওকে ধর। মৃত্যুঞ্জয়ের স্পর্শে তারকের জ্ঞান ফিরে এলো। উচ্চৈস্বরে তারক কাঁদতে লাগলেন। তাঁর মনে নানা কথার উদয় হল। এক মুখে যেন বলে শেষ হবে না। ঠাকুর বললেন-
প্রভু কয়, মৃত্যুঞ্জয় এই তোতার ছা।
আর কারে দিবি তুই মোরে দিয়ে যা।। শ্রীশ্রী গু.চ.পৃ: ২৯২/১
শুনে সাধু মৃত্যুঞ্জয় বললেন-হে প্রভু, তুমিই এ ব্রহ্মান্ডের মালিক। দেয়া নেয়ার কর্তাও তুমি।
দয়াকরে এ তোতারে যদি তুমি নিলে।।
জনমের মত রাখ কৃপার শৃঙ্খলে।। শ্রীশ্রী ৩.চ.পৃ: ২৯২/১
অমনি মহা প্রভু হরিচাঁদ বললেন- তবে তাই হোক। আমি তোতাকে যে বুলি বলি এই সেই বুলি বলুক।
ঠাকুর এই কথা বলার সংগে সংগে তারকের মুখ থেকে দেব ভাষায় শ্লোক বের হতে লাগল। তিনি ঠাকুরের বন্দনা করতে লাগলেন। বন্দনা শেষে ঠাকুর তারককে সুস্থ হতে বললেন। এভাবে তিনি হরিচাঁদের কৃপা লাভ করলেন। তাঁর সন্দেহ দূর হল। হরি কৃপাগুণে অধ্যাত্ম শক্তিলাভ করেন। তিনি হরিনামে নিজেও যেমন মেতেছিলেন বহু লোককেও মাতিয়েছিলেন। কালক্রমে তিনি শ্রেষ্ঠ কবিগায়ক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।
আমি পূর্বেই বলেছি, কবিগানের প্রথম দিকে তারকের কণ্ঠে সুর ছিল না। তাতে স্রোতারা বিরক্ত হতেন। গানের বায়না তেমন ভাল পেতেন না। একারণে তিনি মনোকষ্ট নিয়ে কাটাতেন। এক দিন তিনি মনেব্যথা গুরুকে জানালে তিনি হরিচাঁদকে জানাতে উপদেশ দেন। সেই মত তিনি ওড়াকান্দী গিয়ে ঠাকুরকে জানালে ঠাকুর তাঁকে বলেন-তারক, তুমি কোন চিন্তা করো না। হাটে হাটে তুমি সাত হাট সবাইকে বলবে তোমার গলায় সুর নেই। তাতে মানুষ দূর দূর করবে। এ কাজ করলে তুমি সুফল পাবে। তোমার কন্ঠে ভাল সুর হবে। তোমার গানে পাষাণও গলবে। ঠাকুরের আজ্ঞামত তারক তাই পালন করলেন। পরবর্তীকালে তাঁর কণ্ঠে অপূর্ব সুর হয়েছিল।
তারকচন্দ্র সরকারের জীবনের কয়েকটি বিশেষ ঘটনা:
(১)
একবার তারক চন্দ্রের কবিগানের বায়না হয় ঢাকাতে। সেখানে বহু পন্ডিতের আগমন হবে। বিপক্ষ সরকার যিনি আসবেন তিনি হয়তো শাত্রজ্ঞ ও পন্ডিত হবেন। তখনকার দিনে বিপক্ষ সরকার কে আসবেন তা কাউকে জানানো হতো না। যাইহোক তারকের মনে খুব ভয় হল। তিনি বিপদের বান্ধব হরিচাঁদের কাছে এলেন। ঠাকুরকে প্রণাম করে বসে রইলেন কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বললেন না।
অন্তর্যামী ঠাকুর তারকের মন জেনে বললেন- তারকবে, আমি যার সহায় আছি তার এত ভয় দেন। প্রেমে মুলদিনে তারকা বলেন- হে দয়াময়, যেখানে যাইনা কেন আমার কোন ভয় নেই, ভয় শুধু কর্মসেজে তোমাকে না হারাই। যখন বলছ তখন- আর ভয় নাই। ঠাকুরকে প্রনাম করে তারক জগৎ জী শান্তিমায়ের কাছে গিয়ে প্রণাম করে ঢাকায় গান করতে যাবার কথা বললেন। স্নেহমাখা সুরে মা বললেন তুমি ঢাকায় যাচ্ছ সেটা আমি জানি। সেখানে নাকি ভাল শাঁখা পাওয়া যায়। তাই আমার জন্য এন্ড জোড়া শাখা কিনে এনো। ঢাকায় যাচ্ছ কোন ভয় নেই, শাঁখা কিন্তু নিয়ে এসো। মা বালিকার মত জোড়া পাথ কিনে আনেয় জানালেন। তারক স্বীকার করে মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে ঢাকায় রওনা হলেন।
নির্দিষ্ট দিনে তারকচন্দ্র দলবল সহ ঢাকার আসরে হাজির হলেন। গানের আসরে বহুলোক। বিপক্ষ সরকার শাস্ত্রজ্ঞানে পন্ডিত, গায়ক হিসেবে সুদক্ষ। কী হবে কী জানি, তারকের মনে সেই ভয়। নিশ্চই আজ পরাজয় হবে। তাই নিরালে বসে হরিচাঁদকে ভেবে কাঁদতে লাগলেন এবং আরোপে ঠাকুরতে দেখলেন। সর্বশক্তির মূলাধার যার সহায় অন্য কোন শক্তিতে কী তারে পরাজিত করা যায়? ঐ দিয়ে তারকের কণ্ঠে যে গান হল তা অপূর্ব। তাঁর সুর, ছন্দ ও শাস্ত্র আলোচনায় স্রোতারা মুগ্ধ হলেন। তাঁর মুখ দিয়ে যেন মুক্তো ঝরছিল। স্রোতারা চোখের জলে আপ্লুত হলেন। এভাবে সারারাত গান হল। বিপচ সরকারের গান কেউ শুনতে চাইলেন না। তাঁর গর্ব খর্ব হল। এর পর সকালে ঘটল এক মজার ঘটনা।
প্রভাত বেলায় তারকচন্দ্র পায়খানা করার জন্য একাকী মাঠে গেলে এক কিশোর বালক পর আগলে দাঁড়িয়ে বলল- শোন সরকার মশাই, গতকাল তোমার গান শুনেছি কিন্তু একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পারছিনা, তুমি যখন গানের আসরে কথা বলছিলে তখন তোমর মাথার উপরে একটা ছোট্ট শিশুকে দেখতে পেয়েছিলাম। সেই শিশুটি কে? এখন তাকে কোথায় রেখে এসেছ? ছেলেটির কথা হবে তারকচন্দ্র আশ্চর্যান্বিত হলেন। ভাবলেন-এ বালকতো সামান্য বালক নয়। এ যেন সেই ব্রজের বালত রাখাল রাজা। পেয়েছি যখন তখন আর ছাড়ব না। এই ভেবে তিনি শিশুটিকে ধরতে যান। কিন্তু বালতী হাওয়ায় মিলেয়ে যায়। তারক হায় হায় করে কাঁদতে লাগলেন। ভাবলেন এই মানববেশে নিশ্চই ঠাকুর এসেছিলেন। আমাকে তো বলেছিলেন যে আমার সাথে থাকবেন। সেজন্যই বুঝি গতকাল গানে আমর কোথাও আটকায়নি।
গানশেষে তারকচন্দ্র শাঁখা কিনে পরদিন বাড়ি রওনা হলেন। ওড়াকান্দী এসে ঠাকুরকে প্রণাম করবার পর ঠাকুর বললেন- কী তারক কোন ভাবে ছিলে? রাখাল বালককে ধরতে না পেরে বুঝি তায় তালাসে ওড়াকান্দী এসেছ? ঠাকুরের কথা শুনে তারক কাঁদতে লাগলেন। আদ্যপান্ত সব ঠাকুরকে খুলে। বললেন। ঠাকুর বললেন- সবই আমি জানি তবু তোমার কাছ থেকে শুনে একটু শাস্তি পেলাম। এরপর অন্তঃপুরে গেলেন শাস্তিমার কাছে। মা শাঁখা দেও শাঁখা দেও বলে ছুটে এলেন। তারক শাঁখা দিলে মা খুশী হয়ে বললেন- খুব ভাল শাঁখা এনেছোতো তারক। জানতো লক্ষ্মীকে দান করলে ধন বৃদ্ধি হয়। যতদিন তারক জীবিত ছিলেন, ততদিন তিনি শাস্তিমাকে শাঁখা দিতে ভোলেন নি। করুণাময়ী লক্ষ্মীস্বরূপিনী শাস্তিমার আশীর্বাদে তারকের সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছিল।
(২)
হিন্দু সমাজে বিবাহিত কন্যা মাত্রেই শঙ্খের তৈরী শাঁখা পরে থাকেন। তারক চন্দ্র প্রতিবছর গকায় কবিগান করতে গেলে শাস্তিমার জন্য শাঁখা আনতেন এটা পূর্বেই বলেছি তারক চন্দ্র প্রতিবছর চর্বিগঙ্গা নদীর অপর পারে লক্ষ্মীপাশায় বিখ্যাত সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির অবস্থিত।তার বাড়ির দক্ষিণে সুন্দির হিসেবে জনশ্রুতি আছে। ঐ মান্দিরের কালী মাতার শখ হল তারক চন্দ্রের মেয়ে হিসেবে তাঁর কাছে থেকে শাঁখা নিয়ে পরবেন।
একবার এক শাঁখারী শাঁখা বিক্রির উদ্ধেশ্যে লক্ষ্মীপাশায় এসে মন্দিরে প্রণাম করে শাঁখা বিক্রি করতে চলে যান। ঐ দিন তাঁর বহু শাঁখা বিক্রী হয় এবং লাভও হয়। পরদিন শাঁখা নিয়ে যখন মন্দিরে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালেন আমনি দেখেন এক যুবতী কন্যা মন্দিরে বসে আছেন। তাঁর পরনে লাল পাড়ের সাদা শাড়ী। তাঁর গায়ের রং শ্যামলা, মাথায় একগাদা চুল, কপালে লাল সিদুর, ঠোঁট লাল, মুখে মৃদু হাসি। মেয়েটি হেসে বললেন- বাবা আমাকে এক জোড়া শাঁখা দেও। শাঁখারী মন্ত্র মুগ্ধের মত তাঁকে শাঁখা পরিয়ে দিলেন। টাকা চাইলে মেয়েটি বললেন-আমি মন্দিরে পূজো দিতে এসেছি, আমার পিতার নাম তারক সরকার। বাড়ী নদীর ওপারে জয়পুর গ্রামে। তাঁর কাছে গেলে টাকা দিয়ে দেবে। তুমি আগে যাও, আমি পূজো দিয়ে পরে আসছি। বাবার মনে না পড়লে বলবে ঝাঁপির মধ্যে টাকা আছে। শাঁখারী মেয়েটির কাথায় সরল বিশ্বাসে তারকের বাড়ি গিয়ে দেখেন তিনি বারান্দায় বসে আছেন। শাঁখার দাম চাইতেই তারক চন্দ্র বিস্ময়ে হেসে বললেন- আমি তো বিয়েই করিনি, মেয়ে আসবে কোথাথেকে? দেখ কে তোমাকে ঠকিয়েছে। শাঁখারীর কথা তাঁর বিশ্বাস হলো না। কারণ ঐ টাকার কথা তিনি ভিন্ন আর বেউ জানতেন না। তিনি ঝাঁপি থেকে টাকা এনে দিয়ে বললেন- চল দেখি কোথায় আমার মেয়ে রয়েছে। শাঁখারী তাঁকে নিয়ে মন্দিরে এসে দেখেন মেয়েটি নেই। তাহলে নিশ্চই তাঁকে ফাঁকি দিয়েছে। মেয়েটিকে খুঁজতে মন্দিরে গিয়ে তিনি আরো অবাক হলেন। দেখেন কালী মূর্তির হাতে তাঁর সেই শাঁখা শোভা পাচ্ছে। মূর্তির মুখে মৃদু মৃদু হাসি। তারকের আর বুঝতে বাকী রইল না। তিনি শাঁখারীকে জড়িয়ে ধরে বললেন- তুমি ধন্য, মায়ের সাক্ষাৎ দর্শন পেয়েছো। আজ তোমাকে জড়িয়ে ধরে আমিও ধন্য হলাম। শাঁখারীও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তারকের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। বললেন- আজ তোমার জন্যই মায়ের দর্শণ পেলাম কিন্তু ভাগ্য দোষে পেয়েও হারালাম। শোনা যায় ঐ শাঁখারী পরবর্তী কালে শাঁখার ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ করেছিলেন।
কবিরসরাজ তারক চন্দ্র সরকারের গুণের কথা বলে শেষ করা যায় না। হরিচাঁদের জীবনী গ্রন্থ 'শ্রীশ্রী হরি লীলামৃত' রচনা তাঁর অমর কীর্তি। ঠাকুরের জীবদ্দশায় হরিভক্ত মৃত্যুঞ্জয় ও দশরথ গ্রন্থ রচনার ইচ্ছা প্রকাশ করেণ এবং কিছু অংশ লিখে তাঁরা ঠাকুরের কাছে যান এবং গ্রন্থ লেখার অভিপ্রায় জানান। ঠাকুর তাঁদের গ্রন্থ লিখতে নিষেধ করেন। তাঁরা সে কথা না শুনে বাড়ি এসে পুনরায় গ্রন্থ লেখা শুরু করেন। ইচ্ছাময়ের ইচ্ছা না হলে সে কাজ করা যায় না। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। অকস্মাৎ গ্রন্থটি হারিয়ে গেল। বহু খোঁজা খুঁজি করে তা পাওয়া গেল না। তাই গ্রন্থ আর লেখা হল না। (৩)
শিখতে হরিচাদের তিরোধানের পর মৃত্যুঞ্জয় ও দশরথ পুনরায় আগ্রহী হন এবং তারক চন্দ্রকে খং না। অতঃপর ঘটল তে কাপর্ব ঘটনা। লিখতে বলেন। মনের ভয়ে তামিলেন। হরিচাদের কথা স্মরণ করে কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ভিও ঘুমিয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর স্বপ্নে এক নারী এসে এসে তারকের মাথায় বরাভয় হাত রেখে স্বপ্নোর আমরা এখন শ্রীধাম ওড়াকান্দীতে এসেছি। অগ্রগণ্য। তোমার এগানাহ। আমার বুক লীনাগীতি রচনা করে এসেছ। এবারও তোমাকে লিখতে হবে। সেই জন্যই প্রভু হরিচাঁদ দশরবরে এবার তোমাকে জয়পুর লিখতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু একনিষ্ঠ ভক্ত দশরথ সেটা শোনেনি। সেই জন্য সেই লীলাগীরি লিখতে নিষেধ করেছিলেন। বিকল সেই প্রথম লেখা গ্রন্থ তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি। তুমি লেখা শুরু কর। এই বলে দয়াময়ী গ্রন্থটি তারকের হাতে দিয়ে অন্তর্ধান হলেন। অর্ধনিদ্রা জাগরণে তারক তাই দেখলেন। তুমি ঠাকুরের
ব্রাহ্মমুহূর্তে তারক উঠে দেখেন তাঁর হাতে সেই গ্রন্থ। তখন রাতের স্বপ্নের কথা তাঁর মনে পড়ে গেল। গ্রন্থ বুকে চেপে ধরে তিনি হায় হায় করতে লাগলেন। এভাবে তিনি তাঁর করুণা লাভ করেন। তিনি এত কূপা পেয়েও সাহসী হচ্ছিলেন না। আবার এক রাতে গোস্বামী গোলক নৃসিংহ মূর্তি ধরে তাঁরে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন- শোন রে তারক, লীলামৃত না দিলে তোর রক্ষা নেই। হয় তোর রক্ত না হয় লীলামৃত একটা চাই। ভয়ংকর মূর্তি দেখে তারক ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। ভীত মনে তারক লিখয়ে স্বীকৃত হলেন। সেই হতে তিনি হরিচাঁদের জীবন কাহিনী শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত লেখা শুরু করলেন। অপূর্ব কাব্য ছন্দে বইটি লেখা। বইটি পড়লে পাঠক মাত্রে তাঁকে ভাবে-রসে অপুত করে।
(8)
আর একটা কাহিনী বলে শেষ করবো। হরিচাঁদের তিরোধানের পর তাঁর শক্তি গুরুচাঁদে মিধে যায়। সেই তথ্যটি তিনি বড়দিয়ায় কবিগান করতে গিয়ে ঠাকুরের মুখে শূণ্যবাণী ভরে শুনতে পান। তার পর থেকে তিনি হরিচাঁদের অভাব গুরুচাঁদের কাছে গিয়ে মেটাতেন। একটু সময় পেলেই তিনি গুরুচাঁদের কাছে যেতেন।
একবার তিনি শ্রীধামে গুরুচাঁদকে দেখার জন্য রওনা হন। যাবার সময় একটা সুন্দর ফুলের মালা গেঁথে নিয়ে যান ঠাকুরকে দেবেন বলে। মধুমতি নদীর কূলে যখন আসেন তখন বেলা দ্বিপ্রহর। ঘাটে কোন নৌকা নেই। তার পার হবার কোন উপায় নেই। কোন উপায় না থাকায় তিনি হরি বলে কাঁদতে থাকেন।
ভক্তিভাবে ডাকলে ভগবান কী থাকতে পারেন? তিনি যে বিপদের বান্ধব। এদিকে তারকের কান্নায় গুরুচাঁদের আসন টলে উঠেছে। ঠাকুর মা সত্যভামাকে ডেকে বললেন-আমায় শীঘ্র বাবার নৌকার বৈঠাখানা দেওতো। সত্যভামা দেবী শুনে বলেন-এই অসময় বৈঠ্য দিয়ে কি করবেন? উত্তর ঠাকুর বলেন- তারক আমার বাবাকে আকুল হয়ে ডাকছে। সে মধুমতি নদীর কূলে বসে আছে। পর হতে পারছে না। তাকে পার করতে যাব। মা আর দেরী না করে হরিচাদের হাতের বৈঠাখানা বের করে দিলেন।
এদিকে কিছুসময় পর তারক দেখতে পান নদীর ওপার থেকে একটা ছোট্ট ছেলে একখানা নৌকা বেয়ে ধীরে এপারে আসছে। তারকের মনে আশার সঞ্চার হল। এক সময় ছেলেটি নৌকা নিয়ে এপার এসে তারককে বলল-শীঘ্র নৌকায় উঠুন। আমার বাবার শরীরময় ছেলেটি নৌকা নিয়ে পাঠিয়েছেন। তারক দেরী না করে নৌকায় উঠলেন। মনে মনে ভাবলেন ছেলেটি ওপার বেয়ে যেতে পারবে তো? আবার ভাবলেন সেতো নিজেই বেয়ে এসেছে। তিনি নৌকায় উঠে নীরবে বসে রইলেন। মনে মনে ঠাকুরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে লাগলেন।
কিছুক্ষণ পর নৌকাটি নদীর ওপার ঘাটে এসে ভিড়লো। তাড়াতাড়ি রওনা হওয়ায় তারক টাকা আনতে ভুলে গেছেন। তাই পারের পয়সা কীভাবে দেবেন? বললেন খোকা, আমিতো বাড়ি থেকে আসার সময় টাকা আনতে ভুলে গেছি ফেরার সময় তোমাকে পারের পয়সা দিয়ে যাব। ছেলেটি বলল- তাহলে তোমার ঐ মালাটি আমায় দেও বাবাকে দিলে খুশী হবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারক মালাটি তাকে দিয়ে শূণ্য হাতে শ্রীধামে রওনা হলেন। কিছুদুর গিয়ে কী মনে করে আবার ঘাটে ফিরে এলেন। ঘাটে এসে দেখেন সেই ছেলেটিও নেই আর নৌকাটিও নেই। এত অল্প সময়ে কোথায় গেল ছেলেটি? আর নৌকাটিই বা কোথায়? চারিদিক তাকিয়ে কোথাও দেখতে না পেয়ে বিষন্ন মনে আবার রওনা হলেন। বিষয়টি তিনি আঁচ করতে পারলেন না।
শ্রীধামে পৌঁছে কামনা সাগরের পাড়ে বসে ভাবতে থাকেন- মালাটিতো দিয়ে এসেছি, এখন কী নিয়ে ঠাকুরের কাছে যাব? তিনি সেখানে বসে আবার কাঁদতে থাকেন। অন্তর্যামী গুরুচাঁদ অন্তরে সব জেনে বিচরণ পাগলকে ডেকে বললেন- বিচরণ কামনা সাগরের পাড়ে গিয়ে দেখ তারক বসে কাঁদছেন। তাকে বাড়ির মধ্যে নিয়ে এসো। বিচরণ সেখানে গিয়ে দেখেন সত্যিই তারক বসে কাঁদছেন। তিনি তাঁকে বাড়ির মধ্যে নিয়ে এলেন। তারক ভক্তিভাবে গুরুচাঁদকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়িয়ে দেখেন গুরুচাঁদের গলায় তাঁর সেই মালা শোভা পাচ্ছে। তিনি ভাবে বিভোর হয়ে ধূলায় পড়ে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। কেঁদে কেঁদে বললেন-ওরে দয়াল, তোমার দয়ার তুলনা হয় না। এ জন্যই বুঝি ছোট্ট ছেলের রূপ ধরে আমাকে পার করতে এসেছিলে? আর সেই মালাটিও দেখছি তোমার গলায়। এভাবে তুমি আমার আশা পূরণ করলে দয়াল। ঠাকুর গুরুচাঁদ হেসে বললেন- ওঠ তারক, সুস্থ হও। আমার বাবাকে যখন ডেকেছো আমিকী ঘরে বসে থাকতে পারি? তুমি যে আমার বাবার প্রিয় ভক্ত। তুমি বিপদে পড়বে আর আমি দেখবো না তা কি হয়? তারক বললেন- আজ যে ভাবে পার করলে শেষের দিনেও যেন এই ভাবে আমাকে পার করো এই প্রার্থনাটুকু রইল। এরপর ধীরে ধীরে তারক সুস্থ হলেন।। এই ঘটনাটি আমি পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত নদীয়া জেলার বগুলা গ্রামের জনৈক ভক্তের কাছে থেকে শুনেছিলাম। তাঁর নামটি মনে করতে পাছি না বলে দুঃখীত।
সাহিত্যকর্ম:
কিসাহিত্য জগতে প্রথম মতুয়া সাহিত্যিক হলেন তারক চন্দ্র সরকার। মতুয়া সাহিত্যকে তিনি প্রথম পদ্ধিতি জমায়েতেলে ধরেছেন যার প্রথম সূচনা হয়ে ছিল শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত' গ্রন্থ রচনার মধ্যদিয়েচিতর আগে তিনি রচনা করেন বহু মতুয়া সাধন সংগীত। এসব সংগীতের সমষ্টিগত রূপ হল সংগীত পুস্তিকা 'মহাসংকীর্তন'। 'ধানের তুল্য ধন নেই, আর গানের তুল্য সাধন নেই'- গুরুচাঁদের এই আমোঘ বাণীটির সঠিক প্রতি ফলন ঘটেছে মহা সংকীর্তনের সংগীতরাজির মধ্যে দিয়ে। এর ফলে মতুয়া ধর্ম সাধনায় এক নবযুগের সূচনা হয়েছে। এসব গান লোক সংস্কৃতির অঙ্গও বটে। আজও এসব গান ভক্তও সাধারণ মানুষের কণ্ঠে কণ্ঠে গীত হচ্ছে। তাঁর রচিত গান গুলি গাওয়ার সংগে সংগে গায়কের মনে ভাবের দোলা দেয়, ভাব রসে আপ্লুত হয়ে মনে এক অনাবিল আনন্দের জোয়ার বয়ে আনে। ভক্তও ভগবানের মধ্যে এক নৈকট্য এনে দেয়।
খেতাব প্রাপ্তি:
তারক চন্দ্র সরকার ছাত্রবৃত্তি পর্যন্ত পড়লেও অশেষ পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। তিনি করি গায়ক হিসেবে যথেষ্ঠ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাছাড়া কবিগানকে তিনি অশ্লিলতা মুক্তকরে নতুনত্ব দান করেছিলেন। এজন্য তাঁকে আধুনিক কবি গানের জনক বলা হয়। কবির আসরে উঠলে তাঁর ভাব ভাষা ও জটিল প্রশ্নের সুন্দর মিমংসা শুনলে বিশ্বাস করা কঠিন হতো যে তিনি সামান্য লেখাপড়া জানতেন। তারক চন্দ্র কবি গানকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার পর এক নাগাড়ে ৫৪ বছর কবি গান করেছেন। দেশ জুড়ে ছিল তাঁর সুনাম। বিভিন্ন জনের কাছে থেকে তিনি বহু সম্মান ও খেতাব পেলেও 'কবি রসরাজ' খেতাবটি তাঁর নামের সাথে বেশী ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তিনি আরও যে সব খেতাব পেয়েছিলেন সেগুলি হল। তারক ভাগবত, পন্ডিত প্রবর, তারক রসনা, সুকবি, প্রেমিক শিরোমনি, সরকার চূড়ামনি প্রভৃতি। তিনি কোন রাজ সম্মান না পেলেও অগনিত মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন আজীবন।
তিরোধান:
১৩২১ বঙ্গাব্দের ১লা অগ্রহায়ণ (১৯১৪, ১৭ নভেম্বর) মাসে তারক চন্দ্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পূর্ব দিনও তিনি কবিগান করেছিলেন। শোনা যায় মৃত্যুর পর শ্মশানে তাঁকে দাহন করতে গেলে তাঁর চিতার উপর চন্দন ও পুষ্প বৃষ্টি হয়েছিল যা দেখে সকলে বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছিল। মৃত্যুর পরও তিনি কয়েক জন ভক্তকে দেখা দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। তন্মধ্যে চন্দ্রদিঘলিয়াবাসী জগদীশ নামে জনৈক ব্রাহ্মণের নাম উল্লেখযোগ্য। তাঁর কাছে এক জোড়া জুতা কিনে দিয়েছিলেন যা আজও জয়পুরের মন্দিরে সযত্নে সুরক্ষিত আছে।
তত্ত্ব সূত্র - শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও সমসাময়িক ভক্ত চরিত্র, +পৃষ্ঠা :১৫৮-১৬৮)